অর্থনীতি

মহার্ঘ ভাতা দিয়ে কি সরকারি কর্মকর্তাদের খুশি করতে চায় সরকার—সিপিডির প্রশ্ন

সরকার সম্প্রতি সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য ‘মহার্ঘ ভাতা’ দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত কতটা সময়োপযোগী এবং সবার পক্ষে ন্যায্য—তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটির মতে, এই ভাতা চালু হলে সরকারকে অতিরিক্ত ৭ হাজার কোটি টাকার ব্যয়ভার বহন করতে হবে, অথচ এই সুবিধা সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্টের লাঘব করবে না।

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন আজ মঙ্গলবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন,

“সরকারি চাকরিজীবীদের খুশি করতেই কি এই মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হচ্ছে? কারণ, যদি অন্যদের জন্য সমান্তরাল কোনও পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে এই উদ্যোগ স্পষ্টতই পক্ষপাতমূলক হবে এবং এতে সাধারণ মানুষ আরও বেশি মূল্যস্ফীতির চাপে পড়বে।”

কী এই মহার্ঘ ভাতা?

মহার্ঘ ভাতা মূলত একটি মূল্যস্ফীতিভিত্তিক ভাতা, যা সাধারণত কর্মীদের জীবনযাত্রার ব্যয় সামাল দিতে দেওয়া হয়। সরকার বলছে, বর্তমানে যে ৫ শতাংশ ‘বিশেষ প্রণোদনা’ চালু আছে, সেটি তুলে দিয়ে এই মহার্ঘ ভাতা চালু করা হবে। তবে সেটির হার কত হবে বা কাদের কাদের অন্তর্ভুক্ত করা হবে, সে বিষয়ে এখনও বিস্তারিত ঘোষণা আসেনি।

সময়টা কি উপযুক্ত?

সিপিডির মতে, এই মুহূর্তে এই ধরনের ব্যয়ের সিদ্ধান্ত যথেষ্ট বিতর্কিত। কারণ, দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি রয়েছে প্রবল চাপের মুখে। চলতি অর্থবছরের (২০২৪–২৫) প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব আদায়ের হার ছিল অত্যন্ত কম। মার্চ পর্যন্ত রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ২.৮ শতাংশ, যা আগের বছর একই সময়ে ছিল ১০.৭ শতাংশ

সিপিডির হিসাব বলছে, চলতি অর্থবছরের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হলে আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ৬৪.৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে—যা বাস্তবায়ন প্রায় অসম্ভব।

রাজস্ব ঘাটতি কতটা?

এর আগে মার্চে প্রকাশিত সিপিডির বিশ্লেষণে বলা হয়েছিল, এ বছর রাজস্ব ঘাটতি হতে পারে ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ সরকারের আয় ও ব্যয়ের মধ্যে একটি বিশাল ব্যবধান তৈরি হচ্ছে, এবং এই প্রেক্ষাপটে অতিরিক্ত ৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করার সিদ্ধান্তকে ‘অপরিপক্ক’ এবং ‘সময়সীমার বাইরে’ বলা হচ্ছে।

মূল্যস্ফীতি বাড়াবে এই সিদ্ধান্ত?

সিপিডির সম্মানিত ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন,

“একদিকে সরকার রাজস্ব আয় করতে পারছে না, অন্যদিকে ব্যয় বাড়াচ্ছে। এতে ঘাটতি মেটাতে আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ছাপাবে, যার ফলে অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি আরও বাড়বে।”

বর্তমানে দেশের সাধারণ মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে। এর মধ্যেই শুধুমাত্র সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য অতিরিক্ত ভাতা চালু করলে বাজারে চাহিদা আরও বেড়ে যেতে পারে, যা মূল্যস্ফীতি আরও তীব্র করবে।

সাধারণ জনগণের জন্য কিছু থাকছে কি?

সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করেন,

“যদি ভাতা কেবল সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য হয়, তাহলে বেসরকারি খাত, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠী আরও বেশি পিছিয়ে পড়বে। এটি আর্থিক বৈষম্য বাড়াবে এবং সমাজে অস্থিরতা তৈরি করতে পারে।”

তিনি আরও বলেন, সরকার যদি সত্যিই মূল্যস্ফীতি মোকাবিলার জন্য কোনও পদক্ষেপ নিতে চায়, তাহলে অবশ্যই ট্রান্সফার পেমেন্ট বা নগদ সহায়তা কর্মসূচিকে প্রসারিত করতে হবে, যাতে নিম্ন আয়ের মানুষও উপকৃত হয়।

এনবিআরের সংস্কারও প্রশ্নের মুখে

ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, এনবিআর বারবার কর ব্যবস্থা সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবায়নে অনেক দুর্বলতা দেখা যাচ্ছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে রাজস্ব প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ৫.৩ শতাংশ, যেখানে আগের বছর এই হার ছিল ১৩.৭ শতাংশ। এতে বোঝা যাচ্ছে, কর আদায় ব্যবস্থার মূল সংস্কার এখনো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হয়নি।

কী হতে পারে বিকল্প পদক্ষেপ?

সিপিডির মতে, এই মুহূর্তে সরকারের উচিত ছিল—

  • দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে লক্ষ্য করে টার্গেটেড ক্যাশ ট্রান্সফার চালু করা।
  • অবকাঠামো নয়, সামাজিক খাতকে বরাদ্দে প্রাধান্য দেওয়া।
  • এনবিআরের কর নীতিতে সুশাসন ও জবাবদিহি বাড়ানো।

এ ছাড়া রাষ্ট্রীয় ব্যয়ের অগ্রাধিকার নির্ধারণে প্রাক-বাজেট আলোচনায় জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়েছে সংস্থাটি।

সারসংক্ষেপে

বিষয়তথ্য
মহার্ঘ ভাতা৫% বিশেষ প্রণোদনার পরিবর্তে
ব্যয় বাড়বেপ্রায় ৭,০০০ কোটি টাকা
রাজস্ব ঘাটতি সম্ভাব্য১,০৫,০০০ কোটি টাকা
রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধিমার্চ পর্যন্ত ২.৮%
এনবিআর সংস্কারএখনও অগ্রগতিহীন
সিপিডির প্রশ্নএটি সরকারি কর্মকর্তাদের খুশি করতে?
মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button