প্রয়োজনে কাঁচা চামড়া রফতানি করা হবে: প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেছেন, কোরবানির চামড়ার নায্য মূল্য নিশ্চিত করতে প্রয়োজনে কাঁচা চামড়া রফতানি করা হবে। তিনি জানান, সরকার এতিম ও গরিবদের জন্য কোরবানির চামড়ার হক নিশ্চিত করতে আন্তরিকভাবে কাজ করছে। এরই অংশ হিসেবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চামড়া সংরক্ষণের জন্য বিনামূল্যে লবণ সরবরাহের ঘোষণা দিয়েছে। সোমবার (২৬ মে ২০২৫) বাংলাদেশ কৃষি সাংবাদিক ফোরাম (বিএজেএফ) আয়োজিত ‘দেশীয় পশুতে কোরবানি: পশু ও চামড়া ব্যবস্থাপনায় করণীয়’ শীর্ষক সেমিনারে তিনি এসব কথা বলেন। কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটের বাংলাদেশ ফ্রিডি হলে এই সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।
কোরবানির চামড়া ব্যবস্থাপনায় সরকারের প্রতিশ্রুতি
ফরিদা আখতার তাঁর বক্তব্যে জানান, কোরবানির চামড়ার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা সম্ভব। তবে, চামড়া শিল্পের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হলে সঠিক ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনা প্রয়োজন। তিনি বলেন, “কোরবানির চামড়ার ক্ষেত্রে এতিম ও গরিবদের অধিকার নিশ্চিত করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। এ জন্য সরকার বিনামূল্যে লবণ সরবরাহের মাধ্যমে চামড়া সংরক্ষণে সহায়তা করছে। প্রয়োজনে কাঁচা চামড়া রফতানি করে ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা হবে।”
তিনি আরও জানান, চামড়া শিল্পে বাংলাদেশের সম্ভাবনা অপার। তবে, বাজারে চামড়ার মূল্য নির্ধারণে প্রতিবন্ধকতা এবং সংরক্ষণে অব্যবস্থাপনার কারণে প্রতি বছর উল্লেখযোগ্য পরিমাণ চামড়া নষ্ট হয়। এই সমস্যা সমাধানে সরকার বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে চামড়া সংরক্ষণের জন্য আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, সঠিক লবণ প্রয়োগের নির্দেশনা প্রদান এবং বাজারে চামড়ার মূল্য স্থিতিশীল রাখার উদ্যোগ।
কোরবানির মাংস বিতরণে গরিবের হক
ফরিদা আখতার কোরবানির মাংস বিতরণের প্রতি গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, “ইদুল আজহায় গরুর মাংস না খেলে মুসলমান হয় না—এমন একটি ধারণা আমাদের সমাজে প্রচলিত। কিন্তু দুঃখজনকভাবে দেখা যায়, কোরবানির সময় ফ্রিজের বিক্রি বেড়ে যায়। এর মানে, অনেকেই কোরবানির মাংস ফ্রিজে সংরক্ষণ করেন। অথচ কোরবানির মূল উদ্দেশ্য হলো গরিব-দুঃখীদের মধ্যে মাংস বিতরণ করা। আমাদের উচিত গরিবদের হক নিশ্চিত করা।”
তিনি আরও বলেন, কোরবানির মাংস বিতরণের মাধ্যমে সমাজে সাম্য ও সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি শুধু ধর্মীয় দায়িত্বই নয়, বরং একটি সামাজিক দায়িত্বও। তিনি সকলকে এই বিষয়ে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান এবং বলেন, সরকার এই বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে।
পশু পালনে নারীর ভূমিকা
ফরিদা আখতার তাঁর বক্তব্যে পশু পালনে নারীদের অবদানের কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “দেশে যে পশু পালন হয়, তার পেছনে নারীদের অবদান অনস্বীকার্য। বিশেষ করে গ্রামীণ অঞ্চলে নারীরা পশু পালনের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। দেশীয় গরু পালনে নারীদের এই বিশাল কর্মযজ্ঞকে আমাদের আরও সম্প্রসারিত করতে হবে।”
তিনি জানান, সরকার নারীদের পশু পালনে উৎসাহিত করতে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করছে। এছাড়া, দেশীয় জাতের গরু পালনের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, কারণ এটি পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক। তিনি বলেন, “দেশীয় গরু পালনের মাধ্যমে আমরা কেবল অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হব না, বরং পরিবেশের ভারসাম্যও রক্ষা করতে পারব।”
চামড়া শিল্পের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশের চামড়া শিল্প দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রতি বছর ইদুল আজহার সময় প্রচুর পরিমাণে কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করা হয়। তবে, সঠিক সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণের অভাবে এই শিল্পের সম্পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগানো সম্ভব হয় না। ফরিদা আখতার এই বিষয়ে বলেন, “চামড়া শিল্পে আমাদের আরও আধুনিক প্রযুক্তি এবং দক্ষ জনবল প্রয়োজন। সরকার এই বিষয়ে কাজ করছে এবং শিগগিরই এই শিল্পের উন্নয়নে দৃশ্যমান ফলাফল পাওয়া যাবে।”
তিনি আরও বলেন, কাঁচা চামড়া রফতানির সিদ্ধান্ত বাজারের চাহিদা এবং অভ্যন্তরীণ শিল্পের সক্ষমতার ওপর নির্ভর করবে। তবে, রফতানির ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখা এবং পরিবেশবান্ধব প্রক্রিয়া অনুসরণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সরকারের পরিকল্পনা ও ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ
সরকার চামড়া শিল্পের উন্নয়নে বেশকিছু দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে চামড়া প্রক্রিয়াকরণ কারখানার আধুনিকীকরণ, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহার এবং শ্রমিকদের জন্য প্রশিক্ষণ। এছাড়া, কাঁচা চামড়ার মূল্য নির্ধারণে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে সরকার বাজার তদারকি জোরদার করছে।
ফরিদা আখতার জানান, সরকারের লক্ষ্য হলো চামড়া শিল্পকে একটি টেকসই ও লাভজনক শিল্পে রূপান্তর করা। এ জন্য স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, “আমরা চাই চামড়া শিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করুক।”
সেমিনারে অন্যান্য বক্তার মতামত
বিএজেএফ-এর সভাপতি গোলাম ইফতেখার মাহমুদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সেমিনারে আরও বেশকিছু বিশিষ্ট ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। তারা চামড়া শিল্পের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেন। বক্তারা একমত যে, চামড়া শিল্পের উন্নয়নে সরকার, বেসরকারি খাত এবং সমাজের সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।
উপসংহার
কোরবানির চামড়া ব্যবস্থাপনা এবং পশু পালনে নারীদের ভূমিকা নিয়ে ফরিদা আখতারের বক্তব্য বাংলাদেশের চামড়া শিল্পের সম্ভাবনাকে নতুনভাবে আলোকপাত করেছে। সরকারের সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ এবং জনসচেতনতার মাধ্যমে এই শিল্প দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। সেমিনারে উত্থাপিত বিষয়গুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের চামড়া শিল্প একটি নতুন উচ্চতায় পৌঁছাতে পারে।