অর্থনীতি

বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি স্থির, পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কায় কেন দ্রুত কমছে?

বাংলাদেশ যখন দীর্ঘমেয়াদি উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে লড়াই করে চলেছে, তখন একই সময়ে অর্থনৈতিক দিক থেকে আরও সংকটগ্রস্ত দুই প্রতিবেশী—পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা—তাদের মূল্যস্ফীতিকে আশাব্যঞ্জকভাবে কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। অথচ কিছুদিন আগেও এই দুই দেশের মূল্যস্ফীতি ছিল দ্বিগুণ কিংবা তিনগুণ বেশি।

২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতির হার পৌঁছায় ৭৩ দশমিক ৭ শতাংশে। অপরদিকে, পাকিস্তানের সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি ছিল ২০২৩ সালের মে মাসে ৩৭ দশমিক ৩ শতাংশ। কিন্তু ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে পাকিস্তানের মূল্যস্ফীতি নেমে এসেছে মাত্র শূন্য দশমিক ৩ শতাংশে। আর শ্রীলঙ্কা প্রবেশ করেছে নেতিবাচক মূল্যস্ফীতির (deflation) ধারায়, যা বর্তমানে মাইনাস ২ শতাংশ

বাংলাদেশে এখনো মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে। গত দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে দেশে এই অবস্থান বিদ্যমান। দীর্ঘস্থায়ী এই উচ্চ মূল্যস্ফীতি দেশের নিম্ন ও সীমিত আয়ের মানুষের জীবনযাত্রাকে দুর্বিষহ করে তুলেছে এবং ব্যাহত হচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্ভাবনাও।

বাংলাদেশ পিছিয়ে কেন?

বাংলাদেশ এখনও শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তানের মতো কঠিন ঋণ বা বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে না পড়লেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি। বিশেষজ্ঞদের মতে, একাধিক নীতিগত ভুল, বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, তথ্য বিকৃতি এবং সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির সীমাবদ্ধতা এর মূল কারণ।

মূল নীতিগত ভুলগুলো হল:

  1. নীতি সুদের হারে বিলম্ব:
    বিশ্বের অন্যান্য দেশ মূল্যস্ফীতি কমাতে নীতি সুদহার দ্রুত বাড়িয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত কৃত্রিমভাবে সুদহার কম রেখে দেয়। ততদিনে মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। পরে কিছুটা বাড়ানো হলেও তা ছিল অপর্যাপ্ত এবং বাস্তব অর্থে ঋণাত্মক সুদহারই থেকে যায়।
  2. বিনিময় হার ব্যবস্থাপনার বিলম্ব:
    দীর্ঘদিন ডলারের বিনিময় হার কৃত্রিমভাবে ৮৬ টাকায় ধরে রাখা হয়। ফলে বাজারে ডলারের সংকট দেখা দেয়। ২০২৩ সালের মাঝামাঝি এসে যখন হার বাজারভিত্তিক করা হয়, ততদিনে কালোবাজারে ডলারের দাম বেড়ে যায় ১০–১৫ টাকা পর্যন্ত। এর ফলে আমদানি সীমিত হয়ে পড়ে এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ে।
  3. রাজস্ব সংগ্রহ ও ভর্তুকি ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা:
    সরকার রাজস্ব আয় বাড়াতে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। জনপ্রিয়তা হারানোর ভয়ে আয়কর সংস্কারে সাহস দেখানো হয়নি। ফলে বাজেট ঘাটতি বেড়ে যায় এবং বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়, যা সরাসরি মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব ফেলে।
  4. সামাজিক সুরক্ষা দুর্বল:
    পাকিস্তানের বিআইএসপি বা ভারতের বিনামূল্যে খাদ্য কর্মসূচির মতো সার্বজনীন সহায়তা বাংলাদেশে অনুপস্থিত। টিসিবির সীমিত পণ্য বিক্রি ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলো সংকুচিত এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অনেক অংশ এসব সুবিধার বাইরে থাকে।
  5. বাজার তদারকির ব্যর্থতা ও সিন্ডিকেটের আধিপত্য:
    নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারে সিন্ডিকেট প্রভাবশালী। পেঁয়াজ, চাল, চিনি ইত্যাদি পণ্যে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়ানো হয়। সরকারী তদারকি দুর্বল ও রাজনৈতিক প্রভাবে নিয়ন্ত্রিত, যার ফলে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয় না।

শ্রীলঙ্কা কীভাবে পারল?

২০২২ সালে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে শ্রীলঙ্কা। দ্রব্যের আকাশছোঁয়া দাম, জ্বালানির অভাব এবং গণবিক্ষোভের মুখে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। এরপর নতুন প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে দায়িত্ব নেন এবং একটি পরিকল্পিত ও বাস্তবভিত্তিক অর্থনৈতিক সংস্কার শুরু হয়।

মূল পদক্ষেপসমূহ:

  1. নীতি সুদহার দ্রুত বৃদ্ধি:
    নতুন গভর্নরের অধীনে শ্রীলঙ্কা মূল্যস্ফীতি ঠেকাতে দ্রুত সুদহার বাড়ায়, যার মাধ্যমে চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
  2. মুদ্রা বিনিময় হার একক করা:
    অফিশিয়াল ও অনানুষ্ঠানিক বাজারের মধ্যে ব্যবধান কমিয়ে একক বাজার হার নির্ধারণ করা হয়। এর ফলে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বাড়ে।
  3. আইএমএফ-এর সহায়তায় রাজস্ব সংস্কার:
    শ্রীলঙ্কা দ্রুত আইএমএফ-এর সহায়তা নেয় এবং শর্ত অনুযায়ী ভর্তুকি সংস্কার, কর সংগ্রহ বাড়ানো এবং বাজেট ঘাটতি কমাতে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়।

ফলে ২০২৫ সালে শ্রীলঙ্কা প্রবেশ করেছে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চক্রে। বর্তমানে তাদের মূল্যস্ফীতি মাইনাসে।

পাকিস্তানও নিয়ন্ত্রণে এনেছে মূল্যস্ফীতি

পাকিস্তানও ২০২৩ সালে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে। কিন্তু সম্প্রতি তারা ডলার রেট বাজারে ছেড়ে দেওয়া, আমদানি হ্রাস, নির্দেশিত সামাজিক সহায়তা কর্মসূচি চালু ও নীতি সুদহার বাড়িয়ে চাহিদা হ্রাস করার মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে। বর্তমান মূল্যস্ফীতির হার মাত্র ০.৩ শতাংশ

বাংলাদেশের সামনে করণীয় কী?

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের জন্য এখনো সময় আছে নীতিগত ধারাবাহিকতা আনতে। এর জন্য যা করণীয়:

  1. বাস্তব নীতি সুদহার নির্ধারণ করে চাহিদা নিয়ন্ত্রণ।
  2. ডলার বিনিময় হারে স্বচ্ছতা ও বাজারভিত্তিক মূল্যায়ন।
  3. রাজস্ব আয় বাড়িয়ে ভর্তুকি কার্যকরভাবে দরিদ্রদের মাঝে বিতরণ।
  4. সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি বড় পরিসরে চালু করা।
  5. সিন্ডিকেট ভাঙতে বাজার তদারকি জোরদার করা।
  6. পরিসংখ্যানে স্বচ্ছতা ফিরিয়ে এনে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করা।

বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনও পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার মতো চরম সংকটে পড়েনি, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি উচ্চ মূল্যস্ফীতি দারিদ্র্য ও সামাজিক অস্থিরতা বাড়াচ্ছে। সময়মতো কঠোর ও সঠিক পদক্ষেপ না নিলে এই সমস্যা আরও গভীর হতে পারে। প্রতিবেশী দেশগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশকেও এখন নীতি ও ব্যবস্থাপনায় সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button