অর্থনীতি

সবার চিন্তায় নির্বাচন, আর্থিক খাতে কোনো রোডম্যাপ নেই: লুৎফে সিদ্দিকী

দেশের আর্থিক খাতে কোনো সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ নেই বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয় সংক্রান্ত বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী। তিনি জানান, সকলের মনোযোগ এখন শুধু নির্বাচনের রোডম্যাপের দিকে। শনিবার রাজধানীর মতিঝিলে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত এক সেমিনারে এসব কথা বলেন তিনি। এ সময় তিনি আরও উল্লেখ করেন, স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণ নির্ধারিত সময়ে হলেও, জিএসপি (জেনারেলাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্সেস) সুবিধা নিয়ে চলমান মামলা নিয়ে কারও তেমন মাথাব্যথা নেই।

সেমিনারের প্রেক্ষাপট ও উদ্দেশ্য

ঢাকা চেম্বার আয়োজিত এই সেমিনারের মূল উদ্দেশ্য ছিল এলডিসি উত্তরণের প্রেক্ষাপটে বেসরকারি খাতের প্রস্তুতি এবং করণীয় বিষয়ে আলোচনা। বাংলাদেশ ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণের পথে রয়েছে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। তবে, এই উত্তরণের প্রভাব বাণিজ্য, রপ্তানি, এবং বেসরকারি খাতের ওপর কী হবে, তা নিয়ে বিস্তারিত পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেওয়া হয় সেমিনারে।

ব্যবসায়ী নেতারা এবং অর্থনীতিবিদরা এই সেমিনারে তাদের মতামত তুলে ধরেন। তারা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব, রপ্তানি বাণিজ্যে পণ্যের বৈচিত্র্যকরণের প্রয়োজনীয়তা, এবং সময়োপযোগী বাণিজ্য নীতির গুরুত্বের ওপর জোর দেন।

আর্থিক খাতে রোডম্যাপের ঘাটতি

লুৎফে সিদ্দিকী তাঁর বক্তব্যে দেশের আর্থিক খাতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাবের বিষয়টি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “শুধু একটা রোডম্যাপ আমি দেখছি, সেটা হলো ইলেকশন হবে ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে। এটাই আমাদের কাছে থাকা সবচেয়ে নির্দিষ্ট রোডম্যাপ। এটা নিয়ে এখন চিল্লাচিল্লি হচ্ছে যে এটাকে যেন আরেকটু টাইট করা হয়। এটা ছাড়া আর কোনো রোডম্যাপ আছে আমাদের? কোনো সেক্টরে? আমার কোনো ধারণা নেই।”

তিনি আরও জানান, দেশের বাণিজ্যিক উন্নয়নের জন্য সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। তবে, বর্তমানে আলোচনা শুধু রাজনৈতিক বিষয়ের ওপর কেন্দ্রীভূত, যা অর্থনীতির অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোর জন্য ক্ষতিকর। তিনি জিএসপি সুবিধা নিয়ে চলমান আন্তর্জাতিক মামলার বিষয়টিও উল্লেখ করেন, যা দেশের রপ্তানি বাণিজ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে, এ বিষয়ে পর্যাপ্ত আলোচনা বা উদ্যোগের অভাব রয়েছে বলে তিনি মনে করেন।

এলডিসি উত্তরণ ও বেসরকারি খাতের প্রস্তুতি

এলডিসি উত্তরণের প্রক্রিয়া বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ এবং সুযোগ উভয়ই। এই উত্তরণের ফলে বাংলাদেশ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সুবিধা হারাবে, যার মধ্যে রয়েছে জিএসপি সুবিধা। এই পরিস্থিতিতে বেসরকারি খাতের প্রস্তুতি এবং সরকারের নীতিগত সহায়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

সেমিনারে উপস্থিত ব্যবসায়ীরা জানান, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাবের কারণে তারা ব্যবসায়িক কার্যক্রমে নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। বিশেষ করে, রপ্তানি বাণিজ্যে প্রতিযোগিতা বাড়াতে পণ্যের বৈচিত্র্যকরণের ওপর জোর দেওয়া হয়। ব্যবসায়ীরা মনে করেন, বর্তমানে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য বেশিরভাগ তৈরি পোশাক শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। তবে, এলডিসি উত্তরণের পর প্রতিযোগিতা বাড়বে, তাই অন্যান্য খাত যেমন চামড়া, কৃষিপণ্য, ও প্রযুক্তি পণ্যের রপ্তানি বাড়ানোর জন্য পরিকল্পনা প্রয়োজন।

অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ

সানেমের (সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান সেমিনারে বলেন, এলডিসি উত্তরণের জন্য শুধু ট্যারিফ সংস্কারই যথেষ্ট নয়। তিনি বলেন, “শুধু ট্যারিফ রিফর্ম করলেই হবে না। ওভারঅল রিফর্ম, ট্যাক্সেশন রিফর্মের জায়গা থেকে জিনিসটাকে চিন্তা করে আনতে হবে। মর্ডানাইজিং ইমপোর্ট পলিসি, শুধুমাত্র আমি ট্যারিফ লিবারেলাইজ করলাম কিন্তু আমি ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন ইমপ্রুভ করলাম না, তাতেও কিন্তু আমরা এটার লাভটা পাব না।”

তিনি আরও জানান, খাতভিত্তিক আলাদা পরিকল্পনা এবং সময়োপযোগী বাণিজ্য নীতি প্রণয়ন জরুরি। বাণিজ্য সুবিধা বাড়ানো, আমদানি নীতির আধুনিকায়ন, এবং কর ব্যবস্থার সংস্কারের মাধ্যমে বাংলাদেশ এলডিসি উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারবে।

জ্বালানি নিরাপত্তা ও ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতা

সেমিনারে রপ্তানি বাণিজ্যে ভালো করার জন্য জ্বালানি নিরাপত্তা এবং ব্যাংক খাতে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার বিষয়টিও গুরুত্ব পায়। ব্যবসায়ীরা জানান, জ্বালানির নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ এবং ব্যাংকিং খাতে স্বচ্ছতা ও স্থিতিশীলতা ছাড়া রপ্তানি খাতে প্রতিযোগিতা বাড়ানো সম্ভব নয়। বর্তমানে ব্যাংক খাতে সুশাসনের অভাব এবং জ্বালানি সংকট ব্যবসায়ীদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে।

ব্যাংকিং খাতে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার ওপরও জোর দেওয়া হয়। ব্যবসায়ীরা মনে করেন, ঋণের সুদের হার, ঋণ বিতরণে স্বচ্ছতা, এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দক্ষতা বাড়ানো না গেলে বেসরকারি খাতের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে।

সরকারের ভূমিকা ও সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তা

সেমিনারে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। ব্যবসায়ীরা জানান, বিভিন্ন সরকারি সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে ব্যবসায়িক কার্যক্রমে জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, রপ্তানি সংক্রান্ত নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে পর্যাপ্ত সমন্বয় নেই। এই সমস্যা সমাধানে সরকারকে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালনের আহ্বান জানানো হয়।

উপসংহার

এলডিসি উত্তরণ বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলেও, এর জন্য সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ এবং সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। লুৎফে সিদ্দিকীর মন্তব্য থেকে স্পষ্ট, বর্তমানে রাজনৈতিক বিষয়গুলো অর্থনৈতিক পরিকল্পনার ওপর প্রাধান্য পাচ্ছে। তবে, অর্থনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ীদের মতে, সময়োপযোগী বাণিজ্য নীতি, পণ্যের বৈচিত্র্যকরণ, জ্বালানি নিরাপত্তা, এবং ব্যাংকিং খাতে সংস্কারের মাধ্যমে বাংলাদেশ এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারবে। সরকার, বেসরকারি খাত, এবং অর্থনীতিবিদদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা এই ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button