ভারতীয় কোম্পানির সঙ্গে ২ কোটি ১০ লাখ ডলারের চুক্তি বাতিল করলো বাংলাদেশ

বাংলাদেশ নৌবাহিনী ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতাভিত্তিক গার্ডেন রিচ শিপবিল্ডার্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড (জিআরএসই) এর সঙ্গে ২ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার (প্রায় ১৮০ কোটি ভারতীয় রুপি বা ২৫৬ কোটি টাকা) মূল্যের একটি চুক্তি বাতিল করেছে। এই চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান কূটনৈতিক টানাপোড়েনের প্রেক্ষাপটে এসেছে, যা দুই দেশের সম্পর্কের নতুন জটিলতার ইঙ্গিত দেয়। শুক্রবার (২৩ মে ২০২৫) ভারতের একাধিক প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম এই তথ্য প্রকাশ করেছে।
চুক্তির পটভূমি
২০২৪ সালের ১ জুলাই, বাংলাদেশ নৌবাহিনী এবং জিআরএসই-এর মধ্যে একটি অত্যাধুনিক মহাসাগরগামী টাগবোট নির্মাণের জন্য এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি ছিল ২০২৩ সালে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত ৫০০ মিলিয়ন ডলারের প্রতিরক্ষা ঋণ চুক্তির অধীনে প্রথম বড় ক্রয়াদেশ। এই ঋণ চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য ভারতীয় সহায়তা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল।
টাগবোটটি ছিল ৬১ মিটার দৈর্ঘ্য, ১৫.৮ মিটার প্রস্থ, ৪.৮ মিটার ড্রাফট এবং ৬.৮ মিটার গভীরতার একটি উন্নত জাহাজ। এটি ৭৬ টন সামনের এবং ৫০ টন পেছনের বলার্ড পুল ক্ষমতাসহ সর্বোচ্চ ১৩ নট গতিতে চলতে সক্ষম হওয়ার কথা ছিল। জাহাজটির প্রধান কাজের মধ্যে ছিল দূরপাল্লার টানার কাজ, ডকিং সহযোগিতা, উদ্ধার অভিযান, অগ্নিনির্বাপণ এবং সাগরে সীমিত দূষণ নিয়ন্ত্রণ। চুক্তি অনুযায়ী, জিআরএসই-কে ২৪ মাসের মধ্যে, অর্থাৎ ২০২৬ সালের মাঝামাঝি নাগাদ, এই জাহাজটি বাংলাদেশ নৌবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়ার কথা ছিল।
চুক্তিটি স্বাক্ষরের সময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরে গিয়েছিলেন এবং নরেন্দ্র মোদীর তৃতীয় মেয়াদের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। এই সফরের সময় দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছিল, যার ফলশ্রুতিতে এই চুক্তি সম্পাদিত হয়।
চুক্তি বাতিলের প্রেক্ষাপট
চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্তটি এসেছে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সাম্প্রতিক কূটনৈতিক উত্তেজনার মধ্যে। গত জুলাইয়ে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর থেকে দুই দেশের সম্পর্কে টানাপোড়েন শুরু হয়। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোকে (সেভেন সিস্টার্স) স্থলবেষ্টিত অঞ্চল হিসেবে উল্লেখ করেন এবং বাংলাদেশকে এই অঞ্চলের সমুদ্রপথের প্রধান প্রবেশদ্বার হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি চীনকে এই অঞ্চল ব্যবহার করে ব্যবসা সম্প্রসারণের প্রস্তাব দেওয়ায় ভারত সরকার বাংলাদেশের পণ্য পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
১৭ মে ২০২৫-এ ভারত ঘোষণা করে যে, বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাকসহ সাতটি পণ্য আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা এবং মিজোরামের স্থল কাস্টমস হাউস, শুল্ক স্টেশন বা ইন্টিগ্রেটেড চেকপোস্টের মাধ্যমে আমদানি করা যাবে না। এই নিষেধাজ্ঞার পরপরই বাংলাদেশ নৌবাহিনী জিআরএসই-এর সঙ্গে চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়।
ইন্ডিয়া টুডে, হিন্দু বিজনেস লাইন এবং টাইমস অফ ইন্ডিয়ার মতো ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকারের এই সিদ্ধান্ত কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। জিআরএসই তাদের স্টক এক্সচেঞ্জ ফাইলিংয়ে নিশ্চিত করেছে যে, বাংলাদেশ সরকার এই অর্ডার বাতিল করেছে। তবে, বাংলাদেশ বা জিআরএসই-এর পক্ষ থেকে বাতিলের নির্দিষ্ট কারণ সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানানো হয়নি। একটি উচ্চপদস্থ বাংলাদেশি সূত্র বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছে, তারা চুক্তি বাতিলের বিষয়টি জেনেছেন, কিন্তু কেন বা কখন এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, সে বিষয়ে তারা কিছু বলতে পারছেন না।
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের প্রেক্ষাপট
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রায় এক দশক আগে থেকে একটি সর্বাত্মক প্রতিরক্ষা চুক্তি রয়েছে, যার বিস্তারিত ধারাগুলো কখনোই প্রকাশ্যে আসেনি। এই চুক্তির অধীনে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিল বলে ধারণা করা হয়। জিআরএসই-এর সঙ্গে টাগবোট নির্মাণের চুক্তিটি এই প্রতিরক্ষা চুক্তির আওতায় সম্পাদিত হয়েছিল বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
শেখ হাসিনার সরকারের আমলে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। গত আট বছরে ভারত বাংলাদেশকে লাইন অফ ক্রেডিটের আওতায় ৮ বিলিয়ন ডলার সহায়তা প্রদান করেছে। এই তহবিলের মাধ্যমে বাংলাদেশে বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। তবে, শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার পূর্ববর্তী সরকারের নেওয়া বেশ কিছু সিদ্ধান্ত ও আন্তর্জাতিক চুক্তি বাতিল করছে, যার মধ্যে জিআরএসই-এর এই চুক্তিও একটি।
সম্ভাব্য প্রভাব
এই চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত দুই দেশের প্রতিরক্ষা ও বাণিজ্যিক সম্পর্কের উপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলতে পারে। জিআরএসই ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি ঐতিহ্যবাহী ও প্রথম সারির জাহাজ নির্মাতা সংস্থা। এই সংস্থা ভারতীয় নৌবাহিনী ও কোস্ট গার্ডের জন্য নিয়মিত জাহাজ নির্মাণ ও মেরামতের কাজ করে। চুক্তি বাতিলের ফলে জিআরএসই-এর শেয়ার দরে প্রভাব পড়তে পারে, যদিও চুক্তি স্বাক্ষরের সময় এটি পাওয়ার পর সংস্থাটির শেয়ার দর প্রায় ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল।
অন্যদিকে, ভারতের স্থলবন্দরের মাধ্যমে বাংলাদেশের পণ্য পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি বড় অংশ তৈরি পোশাক রপ্তানির উপর নির্ভরশীল, এবং ভারতের এই নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের বাণিজ্যে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ
পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, এই চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র প্রতিরক্ষা খাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি দুই দেশের মধ্যে বৃহত্তর কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের প্রতিফলন। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের নীতি ও সিদ্ধান্তগুলো শেখ হাসিনার আমলের সিদ্ধান্তগুলোর থেকে ভিন্ন দিকে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। এই পরিবর্তন ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ভবিষ্যৎ গতিপথ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের এই সিদ্ধান্ত অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তি, বিশেষ করে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার প্রচেষ্টার অংশ হতে পারে। তবে, এটি ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের আরও অবনতির কারণ হতে পারে, যা দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক গতিশীলতায় নতুন জটিলতা যোগ করবে।
উপসংহার
বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জিআরএসই-এর সঙ্গে ২১০ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত দুই দেশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার প্রতিফলন। ভারতের পণ্য পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা এবং বাংলাদেশের এই প্রতিক্রিয়া দুই দেশের সম্পর্কে নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। এই ঘটনা দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিরক্ষা ও বাণিজ্য সম্পর্কের ভবিষ্যৎ গতিপথের উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে।