প্রবাসীদের ডলার ধরে না রাখার আহ্বান গভর্নরের

রাজধানীর ওয়েস্টিন হোটেলে আয়োজিত ‘বাজারভিত্তিক বিনিময় হারের প্রয়োগ ও প্রভাব’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর প্রবাসী বাংলাদেশিদের উদ্দেশে বলেছেন, দাম বাড়ার আশায় ডলার ধরে রাখবেন না। তিনি সতর্ক করে বলেন, এতে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ, বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা হলেও ডলারের দর স্থিতিশীল থাকবে। দৈনিক বণিক বার্তার আয়োজনে এই গোলটেবিল আলোচনায় বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার, এবং শিল্পপতিরা অংশ নেন।
গোলটেবিল আলোচনার বিবরণ
দৈনিক বণিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত এই গোলটেবিলে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। এছাড়া বক্তব্য দেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন, অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ, পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এম মাসরুর রিয়াজ, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান, জিপিএইচ ইস্পাত ও ক্রাউন সিমেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম, ফেয়ার গ্রুপের চেয়ারম্যান রুহুল আলম আল মাহবুব, প্রাণ–আরএফএল গ্রুপের ফাইন্যান্স ডিরেক্টর উজমা চৌধুরী, মাস্টারকার্ডের কান্ট্রি ম্যানেজার সৈয়দ মোহাম্মদ কামাল, এবং ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নের রিজিওনাল অপারেশন ম্যানেজার শিহাবুল হাসান।
গভর্নরের বক্তব্য: ডলারের দাম ও বাজারভিত্তিক বিনিময় হার
গভর্নর আহসান এইচ মনসুর তাঁর বক্তব্যে বলেন, “অনেক দিন ধরেই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশকে বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার পরামর্শ দিয়ে আসছিল। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য উপযুক্ত সময় নির্বাচন নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে। অনেকে বলেছেন, আইএমএফের শর্ত পূরণ করা সম্ভব নয়। পূর্ববর্তী সরকার এই শর্তগুলো পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছিল, তবে আমরা সবগুলো শর্ত পূরণ করেছি।”
তিনি আরও বলেন, “বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার ফলে ডলারের দামে বড় ধরনের উল্লম্ফন হবে না। বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল, প্রবাসী আয় বাড়ছে, এবং আন্তর্জাতিক বাজারে নিত্যপণ্যের দাম কম। এই পরিস্থিতিতে বাজারভিত্তিক বিনিময় হার কার্যকর করার জন্য এটাই সঠিক সময়।” তিনি আশ্বাস দেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনে হস্তক্ষেপ করবে।
গভর্নর প্রবাসীদের উদ্দেশে বলেন, “ডলার ধরে রাখার প্রবণতা ক্ষতির কারণ হতে পারে। বাজারভিত্তিক বিনিময় হারের ফলে ডলারের দাম বর্তমান হারের আশপাশেই থাকবে। তাই প্রবাসীদের উচিত তাদের আয় দেশে পাঠানো এবং অর্থনীতিতে অবদান রাখা।”
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে গভর্নরের পরিকল্পনা
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে গভর্নর বলেন, “আমাদের লক্ষ্য আগামী জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশে নামিয়ে আনা। পরবর্তী অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে এটি ৫ শতাংশে নেমে আসবে। আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো মূল্যস্ফীতি ৩ থেকে ৪ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা।” তিনি জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে নিত্যপণ্যের দাম কম থাকায় বাংলাদেশের অর্থনীতি এর সুফল পাচ্ছে।
অর্থ পাচার ও রাজনৈতিক অর্থনীতি
অর্থ পাচারের বিষয়ে গভর্নর কঠোর অবস্থান ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, “দেশের অনেকের শত শত কোটি ডলার বিদেশে রয়েছে। তারা বাংলাদেশে অর্থ নিরাপদ নয় ভেবে বিদেশে টাকা রাখছেন। এই পরিস্থিতি পরিবর্তনের জন্য রাজনৈতিক অর্থনীতির উন্নয়ন জরুরি।” তিনি আরও বলেন, “টাকা পাচারকারীদের শান্তিতে ঘুমাতে দেওয়া হবে না। আমরা এমন ব্যবস্থা করব যাতে তারা অর্থ পাচারের সুযোগ না পায়।”
অন্যান্য বক্তাদের মতামত
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, “বাজারভিত্তিক বিনিময় হার নিয়ে অনেকের শঙ্কা ছিল। তবে অর্থনৈতিক যৌক্তিকতার দিক থেকে এটি একটি সঠিক সিদ্ধান্ত। বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করার জন্য উপযুক্ত।” তিনি আরও বলেন, এই পদক্ষেপ বাংলাদেশের অর্থনীতিকে আরও স্বচ্ছ ও বাস্তবসম্মত করবে।
অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ বলেন, “বিলাসী পণ্য আমদানি কমানো গেলে ডলারের চাহিদা অনেকাংশে হ্রাস পাবে। এটি আমাদের অর্থনীতির উপর চাপ কমাবে।” তিনি বাজারভিত্তিক বিনিময় হারের পক্ষে মত দেন এবং এটিকে অর্থনৈতিক সংস্কারের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে উল্লেখ করেন।
জিপিএইচ ইস্পাতের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “আর্থিক খাতে বড় ধরনের সংস্কারের প্রয়োজন ছিল। বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার মাধ্যমে এই সংস্কার শুরু হয়েছে। এটি আমাদের অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করবে।”
পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান এম মাসরুর রিয়াজ বলেন, “২০১৮–১৯ সাল থেকে বিনিময় হার জোর করে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছিল, যা অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর ছিল। বাজারভিত্তিক বিনিময় হারের দিকে যাওয়া একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।”
বাজারভিত্তিক বিনিময় হারের প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশ ব্যাংক গত ১৪ মে ২০২৫ তারিখে ডলারের বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার ঘোষণা দেয়। এই সিদ্ধান্ত আইএমএফের ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ প্যাকেজের চতুর্থ কিস্তি পাওয়ার শর্ত পূরণের অংশ হিসেবে নেওয়া হয়। গভর্নর মনসুর জানান, এই পদক্ষেপ বাংলাদেশের অর্থনীতিকে আরও মুক্ত ও স্বচ্ছ করবে। তিনি বলেন, “বাংলাদেশের বিনিময় হার এখন থেকে দেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতা ও নীতিমালার ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে। কোনো অসাধু ব্যবসায়ী বা ব্যাংক যেন অযৌক্তিক দামে ডলার কেনাবেচা করতে না পারে, সেজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক কঠোর তদারকি করবে।”
অর্থনৈতিক প্রভাব ও ভবিষ্যৎ
বাজারভিত্তিক বিনিময় হার চালুর ফলে প্রাথমিকভাবে বাজারে কিছু অস্থিরতার আশঙ্কা থাকলেও গভর্নর আশ্বাস দিয়েছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রস্তুত। তিনি বলেন, “কেউ যদি বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করে, তাদের কঠোরভাবে দমন করা হবে।”
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের অর্থনীতিকে আরও প্রতিযোগিতামূলক করবে এবং বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে সহায়ক হবে। তবে, বাজারভিত্তিক বিনিময় হারের সফল বাস্তবায়নের জন্য কঠোর তদারকি এবং সুশাসন নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
উপসংহার
গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থনৈতিক সংস্কারের একটি নতুন অধ্যায় শুরু করেছে। বাজারভিত্তিক বিনিময় হার চালু, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, এবং অর্থ পাচার রোধে তাঁর দৃঢ় প্রতিশ্রুতি দেশের অর্থনীতির জন্য নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতে পারে। তবে, এই সংস্কারের সফলতা নির্ভর করবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সুশাসন, এবং সঠিক নীতি বাস্তবায়নের ওপর। প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রতি গভর্নরের আহ্বান অর্থনীতিতে তাদের অবদান আরও বাড়ানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।