ব্যাংকের ৭৫% ঋণ পুঞ্জীভূত ১.২% গ্রাহক হিসাবে

বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে ঋণ ও আমানতের কেন্দ্রীভবন ক্রমেই উদ্বেগজনক আকার নিচ্ছে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের ব্যাংকগুলোর মাত্র ১ দশমিক ২ শতাংশ গ্রাহকের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে মোট ব্যাংকঋণের প্রায় ৭৫ শতাংশ। একইভাবে মাত্র ০.১ শতাংশ ব্যাংক হিসাবধারীর কাছে জমা রয়েছে ব্যাংকের মোট আমানতের ৪২ শতাংশ অর্থ। এই চিত্র তুলে ধরেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই)।
এই তথ্য উঠে আসে বুধবার রাজধানীর গুলশানের হোটেল লেকশোরে আয়োজিত এক সেমিনারে, যেখানে ‘বাংলাদেশে আর্থিক খাতের উন্নয়নের গতিধারা’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। সেমিনারটি যৌথভাবে আয়োজন করে পিআরআই, বাংলাদেশ ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল গ্রোথ সেন্টার (IGC)।
পুঞ্জীভূত ঋণ বিতরণে বৈষম্য স্পষ্ট
গবেষণা অনুযায়ী, দেশে বিভিন্ন ব্যাংকের গ্রাহকদের ঋণ হিসাবে ১ কোটি টাকা বা তার বেশি ঋণ দেওয়া হয়েছে মোট ১.২ শতাংশ অ্যাকাউন্টে। অথচ এই ক্ষুদ্রসংখ্যক হিসাবেই জমা হয়েছে পুরো ব্যাংকঋণের তিন-চতুর্থাংশের বেশি অর্থ। এমন ঋণ কাঠামো অর্থনীতিতে বৈষম্য সৃষ্টি করছে বলে মত বিশ্লেষকদের।
পিআরআইয়ের গবেষণাপত্রে আরও বলা হয়, গত পাঁচ বছরে দেশের ১২৬টি উপজেলায় ব্যাংকঋণ অ্যাকাউন্টের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। বিপরীতে, ৬০টি উপজেলায় এই সংখ্যা দ্বিগুণ বা তারও বেশি বেড়েছে। এই বৈষম্য আরও স্পষ্ট হয় ভৌগোলিক বিতরণে—দেশের মোট ব্যাংকঋণের ৬৩ শতাংশই ঢাকায় এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৫.৫ শতাংশ চট্টগ্রামে বিতরণ করা হয়েছে। অর্থাৎ, দেশের ব্যাংকঋণের ৭৮ শতাংশই ঢাকাকেন্দ্রিক।
অমানতের ক্ষেত্রেও একই প্রবণতা
ব্যাংক আমানতের ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে অনুরূপ প্রবণতা। মাত্র ০.১ শতাংশ ব্যাংক হিসাবে রয়েছে মোট আমানতের ৪২ শতাংশ অর্থ। এই হিসাবগুলোতে অন্তত ১ কোটি টাকা বা তার বেশি পরিমাণে টাকা জমা রয়েছে। ২০১৯ সালে এ সংখ্যা ছিল ৪৪.৩ শতাংশ, যা কিছুটা কমলেও সামগ্রিক বৈষম্যের চিত্র অপরিবর্তিত রয়েছে।
গবেষণা অনুসারে, ঢাকা জেলায় রয়েছে ব্যাংকের মোট আমানতের ৫১.৭৯ শতাংশ। এরপরেই রয়েছে চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লা ও নারায়ণগঞ্জ। ঢাকায় মাথাপিছু আমানতের পরিমাণ প্রায় ৬ লাখ ১৩ হাজার টাকা, যা চট্টগ্রামে ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা এবং সিলেটে ১ লাখ ৮ হাজার টাকা। অথচ দেশের ৬০টিরও বেশি জেলায় মাথাপিছু আমানত ১ লাখ টাকার নিচে।
শরীয়তপুর ও জামালপুরে দ্রুত আমানত বৃদ্ধির প্রবণতা
তবে আশাব্যঞ্জক বিষয় হলো, গত পাঁচ বছরে ৪৭টিরও বেশি জেলায় ব্যাংক আমানতের পরিমাণ ৬০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। এর মধ্যে শরীয়তপুর ও জামালপুরে সর্বোচ্চ ৯০ শতাংশ আমানত বৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে। এ ধরনের প্রবৃদ্ধি ভবিষ্যতে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষায় সহায়ক হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
ঋণ বরাদ্দে শিল্প এগিয়ে, কৃষি খাতে অবহেলা
২০১৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সময়ে ব্যাংকের মোট ঋণের মধ্যে ৪০-৪২ শতাংশ বরাদ্দ পেয়েছে শিল্প খাত। তবে কৃষি খাতে বরাদ্দ মাত্র ৪-৫ শতাংশ, যা দেশের কৃষিনির্ভর অর্থনীতির জন্য যথেষ্ট নয় বলে সমালোচনা রয়েছে।
অর্থনৈতিক বৈষম্য রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ফল: গভর্নর আহসান এইচ মনসুর
সেমিনারের প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, “যতদিন পর্যন্ত রাজনৈতিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ না হবে, ততদিন পর্যন্ত অর্থনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ সম্ভব নয়। ঢাকাকেন্দ্রিকতা দূর করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছাই মূল বিষয়।”
তিনি আরও বলেন, “বর্তমানে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২৭ বিলিয়ন ডলার। আমাদের লক্ষ্য এটি ৩০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা। তবে সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার একটি অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়।”
ধনীদের পক্ষে কাজ করছে ব্যাংক ব্যবস্থা: মঈন খান
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান সেমিনারে বলেন, “ব্যাংকিং ব্যবস্থা ধনীদের স্বার্থ রক্ষা করে, এটা আগে কেবল ধারণা ছিল। কিন্তু এখন গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে।” তিনি অভিযোগ করেন, দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো ধনীদের পক্ষে পক্ষপাতদুষ্ট।
রাজনৈতিক বোঝাপড়ায় আটকে আছে আর্থিক খাত: সাবেক এনবিআর চেয়ারম্যান
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেন, “ব্যাংক খাতে যে রাজনৈতিক বোঝাপড়া রয়েছে এবং কেন অর্থনৈতিক কার্যক্রম শুধু ঢাকা ও চট্টগ্রামে কেন্দ্রীভূত, তা খুঁজে বের করা জরুরি।” তিনি আরও বলেন, “দেশের টেকসই উন্নয়নের জন্য দরকার অর্থনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ এবং নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে স্বচ্ছতা।”
ব্যাংকিং নেটওয়ার্কের প্রসার: গ্রামীণ শাখার সংখ্যা বেড়েছে
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, ১৯৭১ সালে দেশে ব্যাংকের শাখা ছিল মাত্র ১,১৯৬টি। ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১,৩৬১টিতে, যা প্রায় ১০ গুণ বৃদ্ধি। যদিও শাখা বাড়লেও সেগুলোর মাধ্যমে সরাসরি অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি এখনও প্রশ্নবিদ্ধ।