জুনে রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানোর লক্ষ্য রয়েছে: গভর্নর

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর জানিয়েছেন, চলতি বছরের জুন মাসের মধ্যে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছানোর সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া, আগামী অর্থবছরে এই রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। গতকাল বুধবার (২১ মে) পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি এই পূর্বাভাস তুলে ধরেন। গভর্নর তার বক্তব্যে ব্যাংকিং খাত এবং ক্ষুদ্রঋণের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা করেন। তিনি জানান, উচ্চ সুদের হারে ক্ষুদ্রঋণ বাজারে টিকে থাকা সম্ভব নয় এবং প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এই খাতে সংস্কার আনা হবে।
রিজার্ভ বৃদ্ধির পূর্বাভাস
ড. মনসুর জানান, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি মাসের ১৯ মে পর্যন্ত দেশের মোট রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২৫.৪৪ বিলিয়ন ডলার। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বিপিএম-৬ পদ্ধতি অনুসারে এই রিজার্ভ বর্তমানে ২০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। গভর্নরের মতে, আগামী জুনের মধ্যে এই রিজার্ভ ২৭ থেকে ৩০ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে পৌঁছবে। তিনি আরও বলেন, “আমাদের লক্ষ্য শুধু রিজার্ভ বাড়ানো নয়, বরং এটিকে টেকসইভাবে ধরে রাখা। আগামী অর্থবছরে আমরা এই রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছি।”
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধির পেছনে কয়েকটি মূল কারণ রয়েছে। প্রথমত, রপ্তানি খাতে স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধি এবং রেমিট্যান্স প্রবাহের উন্নতি। দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এবং অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত ঋণ এবং সহায়তা। তৃতীয়ত, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিগত সংস্কার এবং বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা বৃদ্ধি। গভর্নর জানান, এই তিনটি কারণ একত্রিত হয়ে রিজার্ভ বৃদ্ধির পথকে আরও মসৃণ করছে।
ক্ষুদ্রঋণ খাতে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা
অনুষ্ঠানে গভর্নর ক্ষুদ্রঋণ খাতের বর্তমান চ্যালেঞ্জ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। তিনি বলেন, “২৬ শতাংশ সুদের হারে ক্ষুদ্রঋণ টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।” এই উচ্চ সুদের হার গ্রাহকদের জন্য ঋণ পরিশোধ কঠিন করে তুলছে এবং এটি ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ। তিনি জানান, বর্তমানে গ্রাহকরা এজেন্ট ব্যাংক শাখা থেকে অর্ধেক সুদে ঋণ পাচ্ছেন। ফলে, বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়ছে এবং উচ্চ সুদের ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো ধীরে ধীরে বাজার থেকে বাদ পড়ছে।
ড. মনসুর এই প্রেক্ষাপটে ক্ষুদ্রঋণ খাতে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, “ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের ব্যবসায়িক মডেল পুনর্বিবেচনা করতে হবে। নতুন প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনী পদ্ধতির মাধ্যমে তারা গ্রাহকদের জন্য আরও সাশ্রয়ী এবং টেকসই ঋণ সুবিধা প্রদান করতে পারে।” তিনি আরও জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই খাতে নিয়ন্ত্রণ জোরদার করছে এবং সুদের হার কমানোর জন্য প্রয়োজনীয় নীতিগত পদক্ষেপ নেয়া হবে।
ব্যাংকিং খাতে সংস্কার ও প্রতিযোগিতা
ব্যাংকিং খাত নিয়ে আলোচনায় গভর্নর জানান, বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে সংস্কারের কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, “আমরা ব্যাংকিং খাতে স্বচ্ছতা এবং দক্ষতা বাড়ানোর জন্য কাজ করছি। এজেন্ট ব্যাংকিং এবং ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আমরা গ্রাহকদের কাছে আরও সাশ্রয়ী এবং সহজলভ্য সেবা পৌঁছে দিতে চাই।” তিনি আরও বলেন, ব্যাংকিং খাতে প্রতিযোগিতা বাড়ানোর মাধ্যমে গ্রাহকরা উন্নত সেবা পাবেন এবং এটি অর্থনীতির সামগ্রিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে।
গভর্নরের বক্তব্যে ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের গুরুত্বও উঠে আসে। তিনি বলেন, “ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আমরা গ্রামীণ এলাকায় ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দিতে পারছি। এটি আমাদের অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তির লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করছে।” তিনি আরও জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করছে।
অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য রিজার্ভের গুরুত্ব
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ একটি দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক। পর্যাপ্ত রিজার্ভ থাকলে আমদানি ব্যয় মেটানো, বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করা এবং বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখা সম্ভব হয়। গভর্নর জানান, বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে একটি স্থিতিশীল অবস্থানে রয়েছে এবং রিজার্ভ বৃদ্ধির মাধ্যমে এই স্থিতিশীলতা আরও জোরদার হবে।
তিনি বলেন, “আমাদের রিজার্ভ বৃদ্ধির লক্ষ্য শুধু সংখ্যাগত নয়, এটি আমাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা এবং আত্মবিশ্বাসের প্রতীক।” তিনি আরও জানান, আইএমএফের সঙ্গে চলমান ঋণ কর্মসূচি এবং অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তা রিজার্ভ বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
গভর্নরের বক্তব্যে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বিষয়েও আলোকপাত করা হয়। তিনি বলেন, “আমরা শুধু রিজার্ভ বাড়ানোর দিকে মনোযোগী নই, আমরা চাই অর্থনীতির সব খাতে টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে।” তিনি রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণ, বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং শিল্পায়নের ওপর জোর দেন। এছাড়া, তিনি সবুজ অর্থায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আর্থিক খাতের ভূমিকার গুরুত্বও তুলে ধরেন।
ড. মনসুর বলেন, “আমাদের অর্থনীতি এখন একটি রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আমরা চাই, বাংলাদেশ একটি স্থিতিশীল, সমৃদ্ধ এবং টেকসই অর্থনীতির দেশ হিসেবে বিশ্বে পরিচিত হোক।” তিনি আরও জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই লক্ষ্য অর্জনে সরকারের সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করছে।
উপসংহার
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের এই ঘোষণা দেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছে। রিজার্ভ বৃদ্ধির পাশাপাশি ব্যাংকিং ও ক্ষুদ্রঋণ খাতে সংস্কারের মাধ্যমে অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ও প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা সম্ভব। গভর্নরের বক্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে যে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক টেকসই উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।