অর্থনীতি

কর্মসংস্থানমুখী শিক্ষায় বিনিয়োগ বৃদ্ধির পরামর্শ দিলেন আইএলওর কান্ট্রি ডিরেক্টর

বাংলাদেশে কর্মক্ষম তরুণ জনগোষ্ঠীর উচ্চ হার এবং তাদের বড় একটি অংশের বেকারত্বকে সামনে রেখে কর্মসংস্থানমুখী শিক্ষায় বিনিয়োগ বৃদ্ধির পরামর্শ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) বাংলাদেশ অফিসের কান্ট্রি ডিরেক্টর টুমো পুটিআইনেন। তাঁর মতে, দেশের টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য এই বিনিয়োগ অত্যন্ত জরুরি।

আজ সোমবার (১৯ মে) রাজধানীর তেজগাঁওয়ে আইএলওর ঢাকা কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ মন্তব্য করেন তিনি। সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয় তাঁর বিদায় উপলক্ষে, কেননা ৩১ মে টুমো পুটিআইনেনের বাংলাদেশে দায়িত্ব পালনের শেষ দিন। তিনি ২০১৮ সালের ৪ জুন আইএলও বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসেবে যোগ দেন। প্রায় সাত বছর দায়িত্ব পালনের পর এখন তিনি সংস্থার এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ডেপুটি আঞ্চলিক পরিচালক হিসেবে যোগ দিতে যাচ্ছেন।

তরুণদের কর্মসংস্থানে টেকনিক্যাল শিক্ষার গুরুত্ব

টুমো পুটিআইনেন বলেন, “বাংলাদেশে তরুণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা অত্যন্ত বেশি, যা দেশের জন্য এক বিশাল সম্ভাবনার ক্ষেত্র। তবে তাঁদের বড় একটি অংশ কর্মহীন। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রয়োজন এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা, যা তরুণদের কেবল তাত্ত্বিক জ্ঞানে নয়, ব্যবহারিক ও পেশাগত দক্ষতায় সমৃদ্ধ করবে।”

তিনি জোর দিয়ে বলেন, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় সরকারের বিনিয়োগ বাড়ানো উচিত। কর্মসংস্থানমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা গেলে শিক্ষার্থীরা সহজেই কর্মজীবনে প্রবেশ করতে পারবে, এবং দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিও উপকৃত হবে।

বিদেশগামী শ্রমিকদের সুরক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন

সংবাদ সম্মেলনে আইএলও প্রতিনিধি বলেন, “বাংলাদেশ থেকে যেসব শ্রমিক বিদেশে যান, তাঁদের জন্য কাজের নিশ্চয়তা থাকা জরুরি। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, বিদেশে কাজের শর্তাবলি অস্বচ্ছ এবং প্রবাসী শ্রমিকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ নেওয়া হয়।”

এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নয়ন এবং সচেতনতা বৃদ্ধির পরামর্শ দেন তিনি। দক্ষতা থাকলে বিদেশগামী শ্রমিকেরা ন্যায্য সুযোগ ও নিরাপত্তার বিষয়ে সচেতন হতে পারেন এবং হয়রানি এড়াতে সক্ষম হন।

প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার আহ্বান

টুমো পুটিআইনেন বাংলাদেশের জন্য একটি আরও সুসংহত সামাজিক সুরক্ষাব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। তাঁর মতে, প্রাতিষ্ঠানিক চাকরিজীবীদের অনেক সময় সুরক্ষাব্যবস্থার প্রয়োজন না হলেও, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

তিনি বলেন, “সামাজিক সুরক্ষা কেবল আর্থিক সহায়তা নয়, এটি একটি মৌলিক মানবিক অধিকার। দরিদ্র ও অরক্ষিত জনগোষ্ঠীকে রাষ্ট্রীয়ভাবে নিরাপত্তা প্রদান করা হলে সমাজে অন্তর্ভুক্তি ও সমতা নিশ্চিত হয়।”

পোশাক খাতের অগ্রগতি ও শ্রম আইন সংস্কার

রানা প্লাজা দুর্ঘটনার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের পোশাক খাতের পরিবর্তন ও উন্নয়নের ভূয়সী প্রশংসা করেন আইএলও প্রতিনিধি। তিনি বলেন, “রানা প্লাজার পর বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়ন হয়েছে, এবং কর্মপরিবেশও কিছুটা ভালো হয়েছে। তবে এখনও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে বিপুলসংখ্যক শ্রমিক কাজ করছেন, যাঁদের অধিকার সুরক্ষিত নয়।”

এই প্রেক্ষাপটে তিনি বলেন, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতকে ধাপে ধাপে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় আনা প্রয়োজন, যাতে সেখানকার শ্রমিকদের জন্যও ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করা যায়।

শ্রম আইন সংস্কার প্রসঙ্গে টুমো পুটিআইনেন বলেন, “শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব বাস্তবায়ন জরুরি। বর্তমান শ্রম আইন অনেকাংশেই সময়োপযোগী নয়। তাই শ্রমিকের স্বার্থে আইনের হালনাগাদ ও বাস্তবভিত্তিক সংস্কার আবশ্যক।”

দায়িত্ব পালনের স্মৃতিচারণ ও আগাম বার্তা

প্রায় সাত বছর বাংলাদেশে আইএলওর কান্ট্রি ডিরেক্টরের দায়িত্ব পালনকালে দেশের শ্রমনীতি, কর্মসংস্থান ও সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থার বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন টুমো পুটিআইনেন। তিনি বাংলাদেশকে একটি সম্ভাবনাময় দেশ হিসেবে উল্লেখ করেন এবং বলেন, “বাংলাদেশের শ্রম বাজারে বিশাল পরিবর্তন ও অগ্রগতি দেখেছি। তবে এখনো কিছু কাঠামোগত চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যেগুলোর সমাধান হলে বাংলাদেশ আরও দ্রুত অগ্রসর হবে।”

বিদায় বক্তব্যে তিনি সরকার, বেসরকারি খাত, শ্রমিক সংগঠন এবং উন্নয়ন সহযোগীদের ধন্যবাদ জানান এবং ভবিষ্যতেও বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে সহায়তা করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button