১৯ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বিডা’র বৈঠক

বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) উদ্যোগে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে এক গুরুত্বপূর্ণ মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। আজ মঙ্গলবার (১৩ মে) রাজধানীর বিডার কার্যালয়ে আয়োজিত এই সভায় দেশের বিনিয়োগ পরিবেশের উন্নয়ন এবং বিনিয়োগবান্ধব নীতি প্রণয়নের বিভিন্ন দিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়। সভায় মোট ১৯টি রাজনৈতিক দলকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও, জামায়াতে ইসলামী, ন্যাশনাল কংগ্রেস পার্টি (এনসিপি), গণসংহতি আন্দোলন, এবি পার্টি, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দল অংশগ্রহণ করে।
প্রধান উপদেষ্টার ডেপুটি প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার এই মতবিনিময় সভার বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য জানান। তিনি উল্লেখ করেন, সভায় অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ দেশের বিনিয়োগের সম্ভাবনা এবং বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করেছেন। বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী সভায় সভাপতিত্ব করেন এবং বিনিয়োগের প্রসারে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিদের সামনে তুলে ধরেন।
সভায় বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী দেশের বিনিয়োগ পরিবেশকে আরও আকর্ষণীয় এবং সহজ করার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি বলেন, “একটি শক্তিশালী ও টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য বিনিয়োগের কোনো বিকল্প নেই। আমরা বিশ্বাস করি, সকল রাজনৈতিক দলের সম্মিলিত সহযোগিতা এবং গঠনমূলক পরামর্শের মাধ্যমে আমরা একটি উন্নত বিনিয়োগ পরিবেশ তৈরি করতে সক্ষম হব।” তিনি আরও বলেন, বিডা নিয়মিতভাবে বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে মতবিনিময় করে তাদের মূল্যবান মতামত গ্রহণ করে এবং সেই অনুযায়ী বিনিয়োগ নীতি ও কৌশল প্রণয়ন করে।
সভায় অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরির ক্ষেত্রে তাদের নিজ নিজ দলের दृष्टिकोण এবং প্রস্তাবনা তুলে ধরেন। তারা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান আমলাতান্ত্রিক জটিলতা হ্রাস, নীতিগত স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকরণ, এবং বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি সহায়ক ইকোসিস্টেম গড়ে তোলার ওপর জোর দেন। এছাড়াও, তারা ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের (এসএমই) বিকাশে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া এবং দেশীয় বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
জামায়াতে ইসলামীর প্রতিনিধি তাদের বক্তব্যে দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে বিনিয়োগ নীতি প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তার ওপর আলোকপাত করেন। তারা বলেন, বিনিয়োগ এমনভাবে হওয়া উচিত যাতে দেশের সাধারণ মানুষ উপকৃত হয় এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়।
ন্যাশনাল কংগ্রেস পার্টির (এনসিপি) প্রতিনিধি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার কথা বলেন। তিনি উল্লেখ করেন, বিনিয়োগের প্রক্রিয়া যত বেশি স্বচ্ছ হবে, দেশী ও বিদেশী বিনিয়োগকারীরা ততই উৎসাহিত হবে।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রতিনিধি পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়ে বিনিয়োগের নীতিমালা প্রণয়নের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি বলেন, পরিবেশের ক্ষতি করে কোনো প্রকার অর্থনৈতিক উন্নয়ন দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না।
এবি পার্টির প্রতিনিধি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং বিনিয়োগকারীদের অধিকার সুরক্ষার ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা তৈরি করতে হলে একটি শক্তিশালী আইনি কাঠামো অপরিহার্য।
লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) প্রতিনিধি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক বৈষম্য দূর করার জন্য সুষম নীতি গ্রহণের কথা বলেন। তিনি বলেন, দেশের সকল অঞ্চলের সমান উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একটি ভারসাম্যপূর্ণ подход অনুসরণ করতে হবে।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রতিনিধি হালাল বিনিয়োগ এবং শরিয়াহভিত্তিক অর্থায়নের সুযোগ সম্প্রসারণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তারা বলেন, দেশের একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী শরিয়াহসম্মত বিনিয়োগের প্রতি আগ্রহী, তাই এই খাতের বিকাশে সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন।
সভায় অন্যান্য রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরাও তাদের মূল্যবান মতামত ও পরামর্শ তুলে ধরেন। তারা সকলেই একমত পোষণ করেন যে, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য একটি স্থিতিশীল ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ অপরিহার্য। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সুশাসন, এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে বিনিয়োগের ক্ষেত্রকে আরও প্রসারিত করা সম্ভব বলে তারা মনে করেন।
বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিদের মূল্যবান মতামত মনোযোগ সহকারে শোনেন এবং তাদের सुझावগুলোর প্রতি সম্মান জানান। তিনি বলেন, “আপনাদের মূল্যবান মতামত আমাদের বিনিয়োগ নীতি প্রণয়নে সহায়ক হবে। আমরা আপনাদের सुझावগুলো বিবেচনায় নিয়ে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং কার্যকর বিনিয়োগ নীতি কাঠামো তৈরি করার জন্য কাজ করব।” তিনি আরও উল্লেখ করেন, বিডা ভবিষ্যতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আরও বেশি আলোচনা ও মতবিনিময়ের আয়োজন করবে যাতে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দেশের বিনিয়োগের ধারাকে আরও বেগবান করা যায়।
এই মতবিনিময় সভাটি এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হলো যখন বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে। এই লক্ষ্য অর্জনে দেশী ও বিদেশী বিনিয়োগের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বিডার এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ, যা বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নয়নে এবং জাতীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে সহায়ক হবে।
সভায় অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলের নেতারা বিডার এই উদ্যোগকে স্বাগত জানান এবং ভবিষ্যতে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে যেকোনো আলোচনা ও সহযোগিতায় প্রস্তুত থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। তারা আশা প্রকাশ করেন, বিডার এই ধরনের গঠনমূলক আলোচনা অব্যাহত রাখবে এবং তাদের सुझावগুলোকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে।
বিডার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সভায় যেসব রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন না, তাদের সঙ্গেও পরবর্তীতে আলাদাভাবে মতবিনিময় করার পরিকল্পনা রয়েছে। এর মাধ্যমে দেশের সকল প্রধান রাজনৈতিক দলের মতামত ও পরামর্শ বিনিয়োগ নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হবে।
এই মতবিনিময় সভাটি কেবল একটি আনুষ্ঠানিক বৈঠক ছিল না, এটি ছিল দেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য একটি সম্মিলিত প্রয়াস। যেখানে সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলো একে অপরের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করে একটি সাধারণ লক্ষ্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে। বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নত করার এই যৌথ প্রচেষ্টা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিকে আরও ত্বরান্বিত করবে।
সভায় বিনিয়োগের বিভিন্ন খাত, যেমন – অবকাঠামো উন্নয়ন, কৃষি প্রক্রিয়াকরণ, তথ্য প্রযুক্তি, নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং পর্যটন শিল্পের সম্ভাবনা নিয়েও আলোচনা করা হয়। রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা এসব খাতের উন্নয়নে সরকারের নীতিগত সহায়তা এবং প্রণোদনার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। তারা বলেন, এসব খাতের বিকাশ কেবল কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে না, বরং দেশের অর্থনীতিকেও বহুমুখী করবে।
বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিদের আশ্বস্ত করেন যে, সরকার বিনিয়োগের সকল সম্ভাবনাময় খাতকে গুরুত্ব দিচ্ছে এবং এসব খাতের উন্নয়নে প্রয়োজনীয় নীতি ও পরিকল্পনা প্রণয়ন করছে। তিনি বলেন, “আমাদের লক্ষ্য হলো বাংলাদেশকে একটি আকর্ষণীয় বিনিয়োগ কেন্দ্রে পরিণত করা, যেখানে দেশী ও বিদেশী বিনিয়োগকারীরা স্বাচ্ছন্দ্যে বিনিয়োগ করতে পারবে এবং লাভবান হবে।”
এই মতবিনিময় সভাটি একটি সুস্পষ্ট বার্তা দেয় যে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সকল রাজনৈতিক দল একমত এবং একটি শক্তিশালী বিনিয়োগ পরিবেশ তৈরিতে তারা সকলে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। বিডার এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য এবং এটি দেশের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে বলে আশা করা যায়।