অর্থনীতি

পাল্টাপাল্টি শুল্ক কমানোর চুক্তি চীন-যুক্তরাষ্ট্রের

দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর অবশেষে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার বাণিজ্য যুদ্ধ অবসানের একটি সম্ভাবনাময় পথ উন্মুক্ত হয়েছে। দুই পরাশক্তির পাল্টাপাল্টি শুল্কারোপের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে যে বড় আকারের বিঘ্ন ও পুঁজিবাজারে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়েছিল, তা থেকে এবার মুক্তির আভাস মিলছে। সম্প্রতি জেনেভায় অনুষ্ঠিত দুই দিনের উচ্চপর্যায়ের বৈঠকের পর উভয় পক্ষ একটি যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করেছে, যা বৈশ্বিক বাণিজ্যিক সম্পর্কে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

গতকাল সোমবার বার্তা সংস্থা রয়টার্স ও এএফপি সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এই চুক্তির ফলে আগামী ৯০ দিনের জন্য উভয় পক্ষ একে অপরের পণ্যে নতুন করে কোনো আমদানি শুল্ক আরোপ করবে না। একই সাথে, ইতোমধ্যে আরোপ করা বিদ্যমান শুল্ক উল্লেখযোগ্য হারে কমানো হবে, যা বিশ্বজুড়ে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই সাময়িক যুদ্ধবিরতি উভয় দেশকে দীর্ঘমেয়াদী সমাধান ও কাঠামোগত সংস্কারের বিষয়ে আলোচনার সুযোগ করে দেবে।

বাণিজ্য যুদ্ধের প্রেক্ষাপট: যখন শুরু হয়েছিল শুল্কারোপের পালা

২০১৮ সালের শুরুর দিকে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন চীনের বিরুদ্ধে বাণিজ্য ঘাটতি, মেধাস্বত্ব চুরি, প্রযুক্তি স্থানান্তর এবং রাষ্ট্রীয় ভর্তুকির মতো অভিযোগ উত্থাপন করে। এর প্রতিক্রিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনা পণ্যের ওপর একের পর এক অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ শুরু করে। পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে চীনও মার্কিন পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করে এর জবাব দেয়, যা দ্রুতই বিশ্বের বৃহত্তম দুই অর্থনীতির মধ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ বাণিজ্য যুদ্ধে রূপ নেয়। এই বাণিজ্য যুদ্ধ কেবল উভয় দেশের অর্থনীতিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করেনি, বরং বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থা, উৎপাদন খাত এবং পুঁজি বাজারকে মারাত্মকভাবে অস্থিতিশীল করে তুলেছিল।

শুল্কারোপের ফলে বহু আন্তর্জাতিক কোম্পানি তাদের উৎপাদন কেন্দ্র স্থানান্তরে বাধ্য হয়, যার ফলে বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খল মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। কৃষি খাত থেকে শুরু করে প্রযুক্তি পণ্য পর্যন্ত, উভয় দেশের ভোক্তারা উচ্চমূল্যের সম্মুখীন হন। বিশেষ করে, মার্কিন কৃষকরা চীনা বাজার হারানোর ফলে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েন, অন্যদিকে চীনা প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো মার্কিন প্রযুক্তি ও উপাদান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। এই পরিস্থিতি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করে এবং বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা বাড়িয়ে তোলে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এবং বিশ্ব ব্যাংক বারবার সতর্ক করে আসছিল যে, এই বাণিজ্য সংঘাত বৈশ্বিক মন্দার কারণ হতে পারে।

জেনেভা বৈঠক ও চুক্তির বিস্তারিত রূপরেখা

সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের উচ্চপদস্থ বাণিজ্য প্রতিনিধি দলের দুই দিনের নিবিড় বৈঠক শেষে এই যুগান্তকারী চুক্তির ঘোষণা আসে। এই বৈঠকে উভয় পক্ষই বিদ্যমান বাণিজ্য সংঘাতের একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের গুরুত্ব উপলব্ধি করে। চুক্তির মূল দিক হলো, আগামী ৯০ দিনের জন্য দুই দেশ একে অপরের পণ্যের ওপর কোনো নতুন শুল্ক আরোপ করবে না। এই সময়কালকে ‘ট্রুস পিরিয়ড’ বা ‘যুদ্ধবিরতি কাল’ হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে।

এই ৯০ দিনের যুদ্ধবিরতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো বিদ্যমান শুল্ক উল্লেখযোগ্য হারে কমানো। যদিও ঠিক কত শতাংশ শুল্ক কমানো হবে তা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি, তবে ধারণা করা হচ্ছে যে, উভয় পক্ষই একটি উল্লেখযোগ্য অংশের শুল্ক প্রত্যাহার করে নেবে, যা সংশ্লিষ্ট পণ্যগুলোর মূল্য হ্রাস এবং বাণিজ্য প্রবাহ বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে। মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি (পূর্বের প্রদত্ত তথ্যে স্কট বেসেন্টের নামের ভুল সংশোধিত হয়েছে) সাংবাদিকদের জানান, এই চুক্তি একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ এবং এটি উভয় দেশের মধ্যে আস্থা ও সহযোগিতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।

এই ৯০ দিনের মধ্যে, উভয় পক্ষই আরও বিস্তৃত এবং দীর্ঘস্থায়ী বাণিজ্য চুক্তির জন্য আলোচনা চালিয়ে যাবে। এই আলোচনার মূল বিষয়বস্তু হবে বাণিজ্য ঘাটতি কমানো, মেধাস্বত্ব সুরক্ষা, প্রযুক্তি স্থানান্তর নীতি, কৃষি পণ্য ক্রয় এবং চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন উদ্যোগগুলোর ভূমিকা। ওয়াশিংটন চায় চীন তাদের বাজারে আরও বেশি প্রবেশাধিকার দিক এবং বাণিজ্য সংক্রান্ত কাঠামোগত সংস্কার সাধন করুক, যাতে মার্কিন কোম্পানিগুলো চীনা বাজারে ন্যায্য প্রতিযোগিতা করতে পারে।

বৈশ্বিক অর্থনীতিতে প্রভাব ও প্রত্যাশা

চীন-যুক্তরাষ্ট্রের এই পাল্টাপাল্টি শুল্ক কমানোর চুক্তি বৈশ্বিক অর্থনীতিতে তাৎক্ষণিক ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। চুক্তির ঘোষণা আসার পরপরই বিশ্বজুড়ে পুঁজিবাজারে স্বস্তির ঢেউ লাগে। শেয়ারবাজারগুলোতে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা যায় এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে, যেসব খাত বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, যেমন প্রযুক্তি এবং কৃষি খাত, সেগুলোতে নতুন করে আশার সঞ্চার হয়েছে।

অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, এই চুক্তি বৈশ্বিক বাণিজ্য প্রবাহকে স্বাভাবিক করতে এবং অনিশ্চয়তা কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এর ফলে বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির গতি কিছুটা হলেও ত্বরান্বিত হতে পারে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুল্ক হ্রাস এবং বাণিজ্য সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের ফলে পণ্যমূল্য হ্রাস পাবে, যা শেষ পর্যন্ত ভোক্তাদের জন্য লাভজনক হবে। এছাড়া, বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থা স্থিতিশীল হবে এবং কোম্পানিগুলো বিনিয়োগ পরিকল্পনায় আরও আত্মবিশ্বাসী হবে।

তবে, কিছু বিশ্লেষক সতর্ক করে বলছেন যে, এটি কেবল একটি সাময়িক স্বস্তি। বাণিজ্য যুদ্ধের মূল কারণগুলো এখনো অমীমাংসিত রয়ে গেছে। এই চুক্তি মূলত একটি সাময়িক যুদ্ধবিরতি, যা দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের দিকে প্রথম পদক্ষেপ মাত্র।

চুক্তি বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যৎ পথ

যদিও এই চুক্তি একটি ইতিবাচক দিক, তবে এর বাস্তবায়ন এবং ভবিষ্যৎ আলোচনার পথ মোটেই মসৃণ হবে না। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে গভীর কাঠামোগত এবং রাজনৈতিক মতপার্থক্য রয়ে গেছে। মেধাস্বত্ব চুরি, সাইবার নিরাপত্তা এবং রাষ্ট্রীয় ভর্তুকির মতো জটিল বিষয়গুলো নিয়ে ৯০ দিনের মধ্যে একটি ব্যাপকভিত্তিক সমাধান খুঁজে বের করা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং হবে। উভয় দেশের মধ্যে আস্থার ঘাটতিও আলোচনার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে পারে।

চীনকে তাদের অর্থনৈতিক নীতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে হবে, বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন উদ্যোগগুলোকে বাজার-ভিত্তিক প্রতিযোগিতার সুযোগ দিতে হবে এবং বিদেশি কোম্পানিগুলোর জন্য উন্মুক্ততা বাড়াতে হবে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রকে চীনের উদ্বেগের বিষয়গুলো, যেমন প্রযুক্তির ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা এবং বাজার প্রবেশাধিকার সংক্রান্ত সমস্যাগুলো সমাধানের দিকে মনোযোগ দিতে হবে।

যদি ৯০ দিনের মধ্যে একটি ব্যাপকভিত্তিক চুক্তি না হয়, তাহলে পুনরায় শুল্কারোপ এবং বাণিজ্য উত্তেজনা বৃদ্ধির আশঙ্কা থেকে যাবে। এই পরিস্থিতি বিশ্ব অর্থনীতিকে আবারও অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিতে পারে। তাই, উভয় পক্ষকে এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে একটি দীর্ঘমেয়াদী, টেকসই এবং পারস্পরিকভাবে উপকারী চুক্তি সম্পাদনের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও আশা করছে যে, এই দুই অর্থনৈতিক শক্তি বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার স্বার্থে একটি স্থায়ী সমাধানে পৌঁছাতে সক্ষম হবে।

উপসংহার:

চীন-যুক্তরাষ্ট্রের এই শুল্ক কমানোর চুক্তি নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এটি বৈশ্বিক অর্থনীতিতে স্বস্তি ফিরিয়ে এনেছে এবং একটি দীর্ঘ ও ধ্বংসাত্মক বাণিজ্য যুদ্ধের অবসানের ইঙ্গিত দিচ্ছে। তবে, এটি কেবল একটি প্রাথমিক পদক্ষেপ। আসল চ্যালেঞ্জ হলো আগামী ৯০ দিনের মধ্যে গভীরতর এবং কাঠামোগত সমস্যাগুলো সমাধান করা। যদি উভয় দেশ আন্তরিকভাবে আলোচনা চালিয়ে যায় এবং একটি ন্যায্য ও ভারসাম্যপূর্ণ চুক্তি সম্পাদনে সক্ষম হয়, তাহলে তা কেবল তাদের নিজেদের অর্থনীতির জন্যই নয়, বরং সমগ্র বিশ্বের জন্য এক নতুন সমৃদ্ধির পথ উন্মুক্ত করবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই আলোচনার দিকে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে, কারণ এর সাফল্য বিশ্ব অর্থনীতির ভবিষ্যৎ গতিপথ নির্ধারণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button