মার্কিন–চীন বাণিজ্য আলোচনায় অগ্রগতির খবরে চাঙা বিশ্ববাজার, ডলারের দর বেড়েছে

যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে চলমান বাণিজ্য আলোচনায় আশাব্যঞ্জক অগ্রগতির খবরে সোমবার (১২ মে) বিশ্ববাজারে বড় ধরনের ইতিবাচক সাড়া দেখা গেছে। এতে একদিকে যেমন মার্কিন ডলারের মান বেড়েছে, অন্যদিকে বিশ্বের বিভিন্ন স্টক সূচকেও দেখা গেছে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা। বিশ্লেষকদের মতে, এই অগ্রগতির ইঙ্গিত বিশ্বব্যাপী অর্থনীতির জন্য স্বস্তির বার্তা বয়ে আনছে।
ওয়াল স্ট্রিটে ফিউচার সূচকে বড় উত্থান
সোমবার সকালেই যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান স্টক সূচক এসঅ্যান্ডপি ৫০০ ফিউচারস বেড়েছে ১.২ শতাংশ। একই হারে বেড়েছে প্রযুক্তিভিত্তিক নাসডাক ফিউচারস। এর পাশাপাশি ইউরোপীয় বাজারেও চাঙ্গাভাব দেখা যায়—ইউরোস্টক ৫০ ফিউচারস বেড়েছে ০.৯ শতাংশ, জার্মানির ডিএএক্স সূচক ০.৭ শতাংশ এবং যুক্তরাজ্যের এফটিএসই সূচক বেড়েছে ০.৪ শতাংশ।
স্টক ফিউচার্স হলো এমন এক ধরনের চুক্তি, যার মাধ্যমে ভবিষ্যতে একটি নির্ধারিত দামে নির্দিষ্ট পরিমাণ শেয়ার কেনা-বেচার বাধ্যবাধকতা থাকে। এই ফিউচার সূচকের ওঠানামা দেখে বোঝা যায়, মূল লেনদেনে বাজার কোন দিকে যেতে পারে।
ডলারের মান শক্তিশালী, ইউরো ও ইয়েন দুর্বল
বিশ্বের প্রধান মুদ্রাগুলোর বিপরীতে ডলারের মানও বাড়তে দেখা গেছে। ডলার ইনডেক্সের মান বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০০.৬০ পয়েন্টে, যা আগের দিনের তুলনায় ০.২ শতাংশ বেশি। জাপানি ইয়েনের বিপরীতে ডলার ০.৪ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪৫.৯০ ইয়েনে। ইউরোর বিপরীতে ডলার শক্তিশালী হয়ে উঠায় প্রতি ইউরোর দাম কমে হয়েছে ১.১২ ডলার।
তবে এক্ষেত্রে একটি ব্যতিক্রম দেখা গেছে অফশোর ইউয়ানের ক্ষেত্রে—যেখানে ডলারের বিপরীতে ইউয়ানের দর বেড়ে গেছে ০.২ শতাংশ, অর্থাৎ ডলার দুর্বল হয়েছে।
এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলেও ইতিবাচক সাড়া
এশিয়ার বড় বাজারগুলোতেও ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। দিনের শুরুতে জাপানের নিক্কেই সূচক বেড়েছে ০.৩ শতাংশ এবং দক্ষিণ কোরিয়ার কেএস১১ সূচক বেড়েছে ০.৪ শতাংশ। এই প্রবণতা নিশ্চিত করছে যে, বিশ্বজুড়ে বিনিয়োগকারীরা মার্কিন-চীন আলোচনার অগ্রগতিকে ইতিবাচকভাবে নিচ্ছেন।
কী আলোচনা হলো যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে?
সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে এই উচ্চপর্যায়ের বাণিজ্য আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। মার্কিন অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট বলেন, “এই আলোচনায় দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়েছে।” চীনের পক্ষ থেকেও জানানো হয়, দুই দেশের মধ্যে ‘গুরুত্বপূর্ণ ঐকমত্য’ গঠিত হয়েছে এবং ভবিষ্যতের জন্য একটি নতুন ‘অর্থনৈতিক সংলাপ ফোরাম’ গঠনে সম্মত হয়েছে উভয় দেশ।
যদিও এখনো নির্দিষ্ট কোনো চুক্তির ঘোষণা আসেনি, তবে আশা করা হচ্ছে সোমবার (আজ) দিন শেষে উভয় দেশ যৌথভাবে চুক্তি সংক্রান্ত ঘোষণা দিতে পারে।
উচ্চ শুল্ক প্রসঙ্গে বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশা
বর্তমানে চীনা পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ১৪৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ রয়েছে। যদিও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শুরুর দিকে ৬০ শতাংশ শুল্কের কথা বলেছিলেন, তবে বিনিয়োগকারীরা আশা করছেন আলোচনার প্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র হয়তো উচ্চ শুল্ক থেকে পিছিয়ে আসবে। যদি তা হয়, তবে তা হবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য বড় স্বস্তির বার্তা।
পিপারস্টোন রিসার্চ প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র কৌশলবিদ মাইকেল ব্রাউন বলেন, “এখন পর্যন্ত এই আলোচনা থেকে কোনও নেতিবাচক বার্তা আসেনি। বরং এটা বোঝা যাচ্ছে যে, দুই পক্ষ বড় একটি কাঠামো তৈরি করেছে যার মধ্যে ভবিষ্যতে ফলপ্রসূ আলোচনা সম্ভব।”
ভূরাজনৈতিক প্রভাব: ভারত-পাকিস্তান ও ইউক্রেন-রাশিয়া
বিশ্ববাজারে এই ইতিবাচক ধারা তৈরি হওয়ার আরেকটি বড় কারণ হলো সাম্প্রতিক কিছু শান্তিপূর্ণ কূটনৈতিক উদ্যোগ। ভারত ও পাকিস্তান গতকাল যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে পৌঁছেছে। অন্যদিকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি জানিয়েছেন, তিনি তুরস্কে আসন্ন বৈঠকে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে আলোচনায় বসার জন্য প্রস্তুত।
এই সব ঘটনাই বৈশ্বিক অস্থিরতা কমার সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে, যা বাজারে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
সোনার বাজারে মিশ্র প্রতিক্রিয়া
ডলারের মূল্যবৃদ্ধি এবং বাজারে আশাবাদ তৈরি হওয়ায় বিনিয়োগকারীরা কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের দিকে ঝুঁকছেন। ফলে নিরাপদ সম্পদ হিসেবে পরিচিত সোনার দাম কিছুটা কমেছে। সোমবার সোনার দর কমে দাঁড়িয়েছে প্রতি আউন্স ৩,২৬৮ ডলার, যা আগের দিনের তুলনায় ১.৭ শতাংশ কম। এপ্রিল মাসে সোনার সর্বোচ্চ দর ছিল ৩,৫০০ ডলার।
তেলের বাজারেও চাঙ্গাভাব
চীন-যুক্তরাষ্ট্র আলোচনার অগ্রগতি তেলের বাজারেও প্রভাব ফেলেছে। সোমবার সকালে ব্রেন্ট ক্রুড তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ২৩ সেন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৪.১৪ ডলার। ডব্লিউটিআই ক্রুড তেলের দাম বেড়ে হয়েছে ৬১.২৭ ডলার।
বিশ্লেষকদের মতে, যদি বাণিজ্য আলোচনায় চূড়ান্ত চুক্তি হয়, তবে বৈশ্বিক সরবরাহ চেইন স্বাভাবিক হবে এবং তেলের চাহিদা বৃদ্ধি পাবে।