ভারত-পাকিস্তান সংঘাত বাড়লে পাকিস্তানের অর্থনীতিতে ভয়াবহ বিপর্যয়

ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা ও পাকিস্তানের অর্থনীতি
ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে চলমান সামরিক উত্তেজনা নতুন করে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতিতে। আন্তর্জাতিক ঋণমান নির্ধারণকারী সংস্থা মুডিস ইনভেস্টরস সার্ভিস সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, এই উত্তেজনা যদি দীর্ঘস্থায়ী বা বিস্তৃত সামরিক সংঘাতে রূপ নেয়, তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়বে পাকিস্তান। একদিকে যখন দেশটি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF)-এর সহায়তায় অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের পথে রয়েছে, অন্যদিকে যুদ্ধ-পরিস্থিতির সম্ভাবনা তার ওপর নতুন করে ভার চাপাচ্ছে।
মুডিস-এর মতে, যুদ্ধ পরিস্থিতি চলমান থাকলে পাকিস্তানের প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হবে, আর্থিক খাত সংস্কার বাধাগ্রস্ত হবে এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার বহু বছরের প্রচেষ্টায় বাধা আসবে।
অর্থনৈতিক অগ্রগতির মাঝেই অনিশ্চয়তা
মুডিস জানায়, পাকিস্তানের অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে সাম্প্রতিক সময়ে উন্নতির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। দেশটির প্রবৃদ্ধির হার কিছুটা বেড়েছে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে, এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়তে শুরু করেছে। এসবের পেছনে রয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ৭০০ কোটি ডলারের পুনঃঋণ কর্মসূচি, যার আওতায় সম্প্রতি আরও ১০০ কোটি ডলার ছেড়েছে আইএমএফ।
তবে মুডিস হুঁশিয়ারি দিয়েছে, সামরিক উত্তেজনা যদি আরও তীব্র হয় কিংবা দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে পাকিস্তানের পক্ষে আন্তর্জাতিক ঋণদাতাদের আস্থা অর্জন করা কঠিন হবে। ফলে রিজার্ভে চাপ বাড়বে, ঋণ প্রাপ্তি কঠিন হবে, এবং দেশটি নতুন করে বৈদেশিক অর্থায়নের সংকটে পড়তে পারে।
সিন্ধু চুক্তি স্থগিত: কৃষি উৎপাদনে বিপর্যয়
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ১৯৬০ সালে স্বাক্ষরিত সিন্ধু পানি বণ্টন চুক্তি সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের পক্ষ থেকে একতরফাভাবে স্থগিত করা হয়েছে। এর ফলে পাকিস্তানে পানিপ্রবাহ হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। মুডিস সতর্ক করেছে, এতে কৃষি উৎপাদন হুমকির মুখে পড়বে, যা একদিকে খাদ্য নিরাপত্তা হ্রাস করবে, অন্যদিকে কৃষি নির্ভর অর্থনীতিতে আরও চাপ সৃষ্টি করবে।
ভারতের অবস্থান তুলনামূলক স্থিতিশীল
মুডিস-এর মতে, চলমান উত্তেজনায় ভারতের অর্থনীতি বড় ধরনের বিপদের মুখে পড়বে না। এর পেছনে প্রধান কারণ হলো—ভারতের অভ্যন্তরীণ ভোক্তা চাহিদা এবং সরকারি বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধিকে টিকিয়ে রাখবে।
২০২৪ সালে ভারতের মোট রপ্তানির মাত্র ০.৪ শতাংশ গেছে পাকিস্তানে, অর্থাৎ দেশটির সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ক অত্যন্ত সীমিত। ফলে পাকিস্তান-সংক্রান্ত সংঘাত ভারতের অর্থনীতিতে তেমন প্রভাব ফেলবে না।
তবে, সামরিক খরচ বৃদ্ধি পেলে ভারতের বাজেটে চাপ তৈরি হতে পারে এবং তা প্রবৃদ্ধিতে আংশিক প্রভাব ফেলবে বলেও রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।
অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের পথ থমকে যেতে পারে পাকিস্তানে
মুডিস বলছে, পাকিস্তান সরকার গত কয়েক বছর ধরে যেসব আর্থিক সংস্কার নিয়েছে, সেগুলোর ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলবে যদি যুদ্ধ পরিস্থিতি তীব্র হয়। এর ফলে বাজেট ঘাটতি বাড়বে, মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি পাবে এবং বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমে যাবে।
এরই মধ্যে পাকিস্তানি রুপির দরপতন ঘটেছে। একইসঙ্গে পাকিস্তানের শেয়ারবাজারে বড় ধরনের পতন দেখা গেছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও সীমান্ত উত্তেজনা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ভয় তৈরি করেছে, যার প্রভাব অর্থনীতির প্রায় সব খাতে পড়ছে।
বেসরকারি বিনিয়োগ ও উন্নয়ন পরিকল্পনার বাধা
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (ADB) পূর্বাভাস দিয়েছিল, ২০২৫ সালে পাকিস্তানে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে এবং সরকারি সংস্কারের কারণে অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আসবে। কিন্তু চলমান সংঘাত সেই আশায় পানি ঢেলেছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং যুদ্ধের সম্ভাবনায় কোনো বিনিয়োগকারীই সহজে ঝুঁকি নিতে চায় না।
সংঘাত দীর্ঘায়িত হলে কী ঘটতে পারে?
- IMF ও বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি ঝুলে যেতে পারে
- দেশীয় মুদ্রার আরও অবমূল্যায়ন
- বৈদেশিক বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে যেতে পারে
- সরকারি ব্যয়ের ওপর চাপ বাড়বে (যুদ্ধ খরচ বৃদ্ধি)
- কৃষিখাত, খাদ্য নিরাপত্তা ও রপ্তানি খাতে বড় ধরনের ক্ষতি
- রিজার্ভ হ্রাস ও আমদানি ব্যয় বেড়ে যাবে
ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়বে, তবে সামষ্টিক স্থিতিশীলতা থাকবে
ভারতের অর্থনীতিও সামরিক খরচ বৃদ্ধির কারণে কিছুটা চাপে পড়বে, তবে তা সীমিত। অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদা ও শিল্প উৎপাদনের কারণে ভারত এই চাপ সামাল দিতে সক্ষম হবে বলে মনে করে মুডিস।
মুডিস-এর বিশ্লেষণ স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সংঘাত তীব্রতর হলে তার সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হবে পাকিস্তান। একটি দেশ যখন অর্থনৈতিক সংস্কার ও পুনরুদ্ধারের পথে থাকে, তখন যুদ্ধ পরিস্থিতি তার অগ্রগতি পুরোপুরি থামিয়ে দিতে পারে।
পাকিস্তান সরকার যদি আন্তর্জাতিক আস্থা পুনরুদ্ধার করতে চায়, তাহলে একদিকে সামরিক উত্তেজনা হ্রাস করতে হবে, অন্যদিকে অর্থনৈতিক সংস্কার অব্যাহত রাখতে হবে। অন্যথায়, পুনরায় চরম মুদ্রাসঙ্কট ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার দিকে দেশটি এগিয়ে যাবে।