অর্থনীতি

১৮৮ কোটি ডলারের আকুর দায় শোধ, রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারের ওপরে

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) ১৮৮ কোটি মার্কিন ডলারের দায় পরিশোধের পরও ২০ বিলিয়ন ডলারের ওপরে টিকে আছে। এই পরিশোধের ফলে মঙ্গলবার দিনের শুরুতে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২২.০৬ বিলিয়ন ডলার, যা দিন শেষে কমে দাঁড়ায় ২০.১৮ বিলিয়ন ডলারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। এই অর্জন দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

আকু: আন্তদেশীয় লেনদেনের একটি কাঠামো

এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়ন (আকু) হলো একটি আন্তদেশীয় লেনদেন নিষ্পত্তির ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে প্রতি দুই মাস পর বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, ইরান, মিয়ানমার এবং মালদ্বীপের মধ্যে বাণিজ্যিক লেনদেনের অর্থ পরিশোধ করা হয়। অতীতে শ্রীলঙ্কাও এই ইউনিয়নের সদস্য ছিল, কিন্তু অর্থনৈতিক সংকটের কারণে তারা বেরিয়ে গেছে। আকুর এই ব্যবস্থা সদস্য দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ককে সুগম এবং সাশ্রয়ী করে তোলে।

বাংলাদেশ গত মার্চ–এপ্রিল সময়ের জন্য আকুতে ১৮৮ কোটি ডলার পরিশোধ করেছে। এর আগে, জানুয়ারি–ফেব্রুয়ারি সময়ের জন্য ১৭৫ কোটি ডলার এবং নভেম্বর–ডিসেম্বর সময়ের জন্য ১৬৭ কোটি ডলার পরিশোধ করা হয়েছিল। এই ধারাবাহিক পরিশোধ বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিশ্রুতি পূরণের সক্ষমতার প্রমাণ বহন করে।

রিজার্ভের স্থিতিশীলতা: একটি ইতিবাচক সংকেত

বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, “বিগত সরকারের আমলে রিজার্ভ যে হারে হ্রাস পেয়েছিল, বর্তমানে সেই প্রবণতা আর নেই। বরং সাম্প্রতিক সময়ে রিজার্ভ কিছুটা স্থিতিশীলতার দিকে এগিয়েছে।” এই স্থিতিশীলতা দেশের অর্থনীতির জন্য একটি ইতিবাচক সংকেত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

২০২১ সালের আগস্টে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সর্বোচ্চ ৪৮.০৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছিল। তবে, পরবর্তী সময়ে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ, আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি এবং ডলারের চাহিদা বৃদ্ধির কারণে রিজার্ভ ধীরে ধীরে হ্রাস পায়। গত বছরের জুলাই মাসে রিজার্ভ নেমে আসে ২০.৪৮ বিলিয়ন ডলারে। তবে, চলতি বছরের এপ্রিলের শেষ নাগাদ রিজার্ভ পুনরায় বেড়ে ২২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়, যা অর্থনীতির জন্য একটি উৎসাহব্যঞ্জক সংকেত।

প্রবাসী আয় ও রপ্তানি আয়ে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, সাম্প্রতিক সময়ে অর্থ পাচার এবং হুন্ডির চাহিদা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। এর ফলে প্রবাসী আয় ২৮.৩৪ শতাংশ এবং রপ্তানি আয় ৯.৮৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই প্রবৃদ্ধি ডলারের বাজারে অস্থিরতা কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ফলে, বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং রিজার্ভের ওপর চাপ কমেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, “আকুর বিল পরিশোধের পর হিসাব এখনো চূড়ান্ত হয়নি। আগামী বুধবারের মধ্যে হিসাব চূড়ান্ত করা হবে। তখন রিজার্ভের প্রকৃত পরিমাণ সম্পর্কে আরও স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে।”

অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার পেছনে নীতিগত পদক্ষেপ

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার পেছনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিগত পদক্ষেপ এবং সরকারের সমন্বিত প্রচেষ্টা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ডলারের বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণ, অর্থ পাচার রোধে কঠোর নজরদারি, এবং রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বৃদ্ধির জন্য প্রণোদনা প্রদানের মতো পদক্ষেপগুলো রিজার্ভের স্থিতিশীলতায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

এছাড়া, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এবং অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচি রিজার্ভ বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। আইএমএফ-এর ঋণ কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশ বিভিন্ন কাঠামোগত সংস্কার বাস্তবায়ন করছে, যা আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা তৈরি করছে।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ

বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশের রিজার্ভের বর্তমান স্থিতিশীলতা অর্থনীতির জন্য একটি শক্তিশালী ভিত্তি প্রদান করছে। তবে, বিশ্বব্যাপী জ্বালানি মূল্যের অস্থিরতা, আমদানি ব্যয়ের চাপ, এবং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতার কারণে ভবিষ্যতে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে পারে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণ, বিনিয়োগ বৃদ্ধি, এবং অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির ওপর জোর দেওয়া প্রয়োজন।

এছাড়া, প্রবাসী আয়ের প্রবাহ অব্যাহত রাখতে প্রবাসীদের জন্য আরও আকর্ষণীয় প্রণোদনা এবং আধুনিক রেমিট্যান্স ব্যবস্থা প্রবর্তন করা গুরুত্বপূর্ণ। একইভাবে, হুন্ডি এবং অবৈধ অর্থ পাচার রোধে আরও কঠোর নজরদারি এবং আইনি কাঠামো শক্তিশালী করা প্রয়োজন।

উপসংহার

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আকুর দায় পরিশোধের পরও ২০ বিলিয়ন ডলারের ওপরে থাকা দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার একটি শক্তিশালী সূচক। প্রবাসী আয় এবং রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি, নীতিগত সংস্কার, এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক প্রতিকূলতা মোকাবিলায় সফলতা অর্জন করছে। তবে, দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে কাঠামোগত সংস্কার এবং বৈচিত্র্যময় অর্থনৈতিক কৌশল গ্রহণ করা অপরিহার্য।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button