অর্থনীতি

আইএমএফ-এডিবির সহায়তা না পেলেও বাস্তবসম্মত বাজেট দেব : অর্থ উপদেষ্টা

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এবং এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) কাছ থেকে প্রত্যাশিত সহায়তা পাওয়া না গেলেও সরকার একটি ব্যবস্থাপনাযোগ্য ও বাস্তবসম্মত বাজেট প্রণয়ন করবে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অর্থ উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান। রবিবার (৪ মে) সচিবালয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে এডিবি’র ভাইস প্রেসিডেন্ট (দক্ষিণ, মধ্য ও পশ্চিম এশিয়া) মি. ইংমিং ইয়াংয়ের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এই মন্তব্য করেন। অর্থ উপদেষ্টার এমন বক্তব্য দেশের অর্থনীতির নীতি নির্ধারণী মহলের দৃঢ়তা এবং বিকল্প পথে বাজেট বাস্তবায়নের সক্ষমতার ইঙ্গিত দেয়। এটি দেশের অভ্যন্তরীণ সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার এবং ব্যয় সংকোচনের ওপর জোর দেওয়ার সরকারি মনোভাবকে প্রতিফলিত করে।

বৈঠকের পর অর্থ উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন। সেখানে তিনি এডিবি ভাইস প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনার বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। তিনি জানান, এডিবির ভাইস প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফরের সময় দেশের অর্থনীতির সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে আগ্রহী ছিলেন। জবাবে তিনি এডিবিকে জানান যে, দেশের অর্থনীতির অবস্থা আগের চেয়ে ভালো হয়েছে এবং সামষ্টিক অর্থনীতিতে (মাইক্রো ইকোনমি) উল্লেখযোগ্য উন্নতি সাধিত হয়েছে। এই উন্নতি অর্জনে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করেন তিনি।

অর্থ উপদেষ্টা ব্যাংকিং খাতে সরকারের নেওয়া ব্যাপক সংস্কার কার্যক্রমের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকার বিভিন্ন নীতি ও পদ্ধতিগত সংস্কার বাস্তবায়ন করছে। এর ফলে ব্যাংক খাতের দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠা এবং আর্থিক স্থিতিশীলতা জোরদার করার প্রচেষ্টা চলছে। যদিও ব্যাংক খাতের সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া এবং এর পূর্ণ সুফল পেতে সময় লাগবে, তবে সরকারের পক্ষ থেকে এই খাতে মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

ট্রেড বা বাণিজ্য খাতকে দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে উল্লেখ করেন অর্থ উপদেষ্টা। তিনি জানান, বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও সহজীকরণে সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে। বেসরকারি খাতের উদ্যোগকে উৎসাহিত করতে এবং বাণিজ্যের প্রতিবন্ধকতা দূর করতে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এই ধারাবাহিকতায় বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণে একটি বাণিজ্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে বলে তিনি জানান, যেখানে বাণিজ্য সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে এবং ভবিষ্যৎ করণীয় নির্ধারণ করা হবে।

সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে আইএমএফ লোন পেতে দেরি হওয়ায় এডিবির বাজেট সহায়তার ওপর এর কোনো প্রভাব পড়বে কিনা এমন প্রশ্ন করা হয়। জবাবে অর্থ উপদেষ্টা জানান, বাজেট সহায়তার বিষয়টি এডিবি আইএমএফ-এর মূল্যায়নের সঙ্গে সমন্বয় করে দেখে। আইএমএফ যেহেতু সামষ্টিক অর্থনীতির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মূল্যায়ন করে, এডিবিও সেদিকে নজর রাখে। তিনি বলেন, এ বিষয়ে তাদের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে এবং আশা প্রকাশ করেন যে সমস্যাগুলোর সমাধান হয়ে যাবে। এর মাধ্যমে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে, আইএমএফের সঙ্গে আলোচনার অগ্রগতির ওপর এডিবির বাজেট সহায়তার বিষয়টি কিছুটা নির্ভর করে, তবে সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রস্তুত।

দেশের অর্থনীতির স্থিতিশীলতা নিয়ে এডিবির সন্তুষ্টির বিষয়ে জানতে চাইলে ড. মসিউর রহমান বলেন, এডিবি স্বীকার করেছে যে অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অর্থনীতি ভালো পারফর্ম করছে। তারা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অর্জন নিয়ে খুশি এবং আশাবাদী। এটি সরকারের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা এবং গৃহীত নীতিগুলোর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি বলে মনে করা হচ্ছে। বিশেষ করে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতার সময়েও বাংলাদেশের অর্থনীতির এই স্থিতিশীলতা বজায় রাখা ইতিবাচক দিক।

অর্থ উপদেষ্টা এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন বা স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের জন্য বাংলাদেশের প্রস্তুতির কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, সরকার ২০২৬ সালে এই উত্তরণের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করছে এবং এডিবিও এ বিষয়ে অবহিত। গ্র্যাজুয়েশন পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাণিজ্য বহুমুখীকরণ, রপ্তানি বৃদ্ধি, মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং নীতি সংস্কারের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। এডিবি বাংলাদেশের এই উত্তরণের প্রক্রিয়াকে সমর্থন করছে এবং প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানে আগ্রহী বলে তিনি জানান।

বাংলাদেশের উন্নয়নে এডিবির অব্যাহত সহায়তার কথা উল্লেখ করে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, এডিবি বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রচেষ্টার একজন গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। তারা বিভিন্ন প্রকল্প সহায়তার পাশাপাশি ব্যাংকিং খাত এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) সংস্কার কার্যক্রমে সহায়তা করে আসছে। এই সহায়তা বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন এবং প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

প্রকল্প সহায়তার চেয়ে বাজেট সহায়তার প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে জানতে চাইলে ড. মসিউর রহমান বলেন, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের জন্য বাজেট সহায়তা অধিক প্রয়োজন। কারণ এটি সরকারের চলতি ব্যয় মেটাতে এবং উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে নমনীয়তা প্রদান করে। তিনি জানান, এডিবি তাদের ‘সফট ল্যান্ডিং উইন্ডো’ বা সহজ শর্তের ঋণ প্রদানের সুযোগ ধীরে ধীরে উন্মোচিত করছে এবং বাজেট সহায়তার জন্য এই উইন্ডো ব্যবহারের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। যদিও এডিবি জানিয়েছে যে এই ফান্ড সীমিত, তবে তারা বিষয়টি বিবেচনা করবে বলে আশ্বস্ত করেছে।

অর্থ উপদেষ্টা আরও বলেন, বাজেট সহায়তার জন্য অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহের উপর জোর দেওয়া হচ্ছে। করের হার বৃদ্ধি না করে বরং করের আওতা এবং পরিধি বাড়ানোর মাধ্যমে রাজস্ব আয় বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। এর ফলে কর ব্যবস্থার আধুনিকায়ন এবং কর ফাঁকি রোধ করা সম্ভব হবে বলে সরকার মনে করে। এটি বাজেট ঘাটতি কমাতে এবং বৈদেশিক নির্ভরতা কমাতে সহায়ক হবে।

আইএমএফ এবং এডিবির কাছ থেকে বাজেট সহায়তা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে যদি অযৌক্তিক শর্ত আসে, তাহলে সরকার তা পুনর্বিবেচনা করবে বলে অর্থ উপদেষ্টা দৃঢ়ভাবে জানান। তিনি বলেন, সরকারের মূল লক্ষ্য হলো বাজেটে অনুৎপাদনশীল খরচ কমানো এবং ব্যয় ব্যবস্থাপনার দক্ষতা বৃদ্ধি করা। এর মাধ্যমে সীমিত সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা যাবে। তিনি পুনর্ব্যক্ত করেন যে, আইএমএফ ও এডিবির সাপোর্ট নাও পাওয়া গেলে সরকার নিজস্ব সক্ষমতার ওপর নির্ভর করে একটি বাস্তবসম্মত বাজেট অবশ্যই দেবে। এই বক্তব্য সরকারের আত্মবিশ্বাস এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার মানসিকতার প্রতিফলন।

এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, আইএমএফ এবং এডিবি বাংলাদেশের অর্থনীতির সংস্কার এবং স্থিতিশীলতা রক্ষায় দীর্ঘকাল ধরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। তাদের ঋণ এবং সহায়তার সঙ্গে প্রায়শই বিভিন্ন শর্ত যুক্ত থাকে, যা অর্থনৈতিক সংস্কার এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হয়। তবে কিছু শর্ত কখনও কখনও দেশের অভ্যন্তরীণ নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে বা স্বল্প মেয়াদে চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে। অর্থ উপদেষ্টার বক্তব্য অনুযায়ী, সরকার কেবল ঋণ বা সহায়তার জন্য অযৌক্তিক শর্ত মেনে নিতে রাজি নয়।

সরকারের পক্ষ থেকে বাজেট প্রণয়নে অভ্যন্তরীণ সম্পদের ওপর জোর দেওয়া এবং ব্যয় সংকোচনের নীতির গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে। এর মানে হলো, কর আদায় ব্যবস্থার আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ, সরকারি ব্যয় ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এবং অনুৎপাদনশীল খাত থেকে সম্পদ সরিয়ে অগ্রাধিকার খাতগুলোতে ব্যয় করা। এটি দীর্ঘ মেয়াদে দেশের অর্থনীতির ভিত্তি মজবুত করবে এবং বৈদেশিক সহায়তার উপর নির্ভরতা কমাবে।

সার্বিকভাবে, অর্থ উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানের বক্তব্য দেশের অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক নির্দেশ করে। এটি একদিকে যেমন আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে গঠনমূলক আলোচনার পথ খোলা রাখে, তেমনই অন্যদিকে দেশের অভ্যন্তরীণ শক্তি ও সম্পদের ওপর নির্ভর করে ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার বার্তা দেয়। একটি বাস্তবসম্মত বাজেট প্রণয়নের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নিশ্চিত করাই সরকারের লক্ষ্য বলে মনে হচ্ছে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button