অর্থনীতি

গত বছর ১,৭০৬ কোটি টাকা লোকসান ন্যাশনাল ব্যাংকের

দেশের বেসরকারি ব্যাংক খাতের প্রথম প্রজন্মের অন্যতম ব্যাংক ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড (এনবিএল) ২০২৪ অর্থবছরে ১,৭০৬ কোটি টাকার বিশাল লোকসান করেছে। আগের বছরের তুলনায় লোকসান বেড়েছে ২০৯ কোটি টাকা বা প্রায় ১৪ শতাংশ। ৩ বছর ধরে ধারাবাহিক লোকসান করলেও এবারও ব্যাংকটি শেয়ারধারীদের কোনো লভ্যাংশ দিতে পারেনি। এর ফলে সবচেয়ে বড় আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন ব্যাংকটির সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।

২০২৪ সালের আর্থিক প্রতিবেদন অনুমোদন ও লোকসানের তথ্য প্রকাশ

গত বুধবার (১ মে) অনুষ্ঠিত ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের বৈঠকে ২০২৪ সালের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুমোদন করা হয়। এরপর ডিএসই ও সিএসই’র মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের জানানো হয় এই লোকসানের খবর। ২০২৩ সালে যেখানে ব্যাংকটির লোকসান ছিল ১,৪৯৭ কোটি টাকা, সেখানে ২০২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১,৭০৬ কোটিতে।

ধারাবাহিক লোকসান এবং ২০২২ সালের রেকর্ড

এটি ছিল ন্যাশনাল ব্যাংকের টানা তৃতীয় বছরের লোকসান। উল্লেখযোগ্যভাবে, ২০২২ সালে ব্যাংকটি করেছিল দেশের ইতিহাসে কোনো ব্যাংকের সর্বোচ্চ একক লোকসান—৩,২৬১ কোটি টাকা। ২০০২ সালে ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনার পর থেকেই ব্যাংকটি লোকসানের বৃত্তে পড়ে এবং এরপর আর মুনাফার মুখ দেখেনি।

ব্যাংকটির আর্থিক সংকটের পেছনের কারণ

অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ন্যাশনাল ব্যাংকের বর্তমান সংকটের মূল কারণ হলো—ব্যাপক ঋণ অনিয়ম, ঋণখেলাপি এবং তারল্য সংকট। ব্যাংকের বিপুল সংখ্যক ঋণ এখন অনাদায়ী হওয়ায় ব্যাংকটি সেগুলোর বিপরীতে কোনো সুদ আয় করতে পারেনি। ফলে আয়ের বড় একটি উৎসই বন্ধ হয়ে গেছে। অন্যদিকে আমানত টিকিয়ে রাখতে ও নতুন আমানত সংগ্রহ করতে গিয়ে বেশি সুদ দিতে হচ্ছে, যা বাড়তি ব্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অনিয়মের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপ

২০২৩ সালের ৫ আগস্ট কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংক ন্যাশনাল ব্যাংকের তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয় এবং একটি নতুন পর্ষদ গঠন করে। এর আগে, সিকদার পরিবার এবং এস আলম গ্রুপের প্রভাবাধীন পরিচালনা পর্ষদের অধীনে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। পর্ষদ পুনর্গঠনের ফলে ব্যাংকটি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও অর্থবছরের প্রায় অর্ধেক সময় ব্যাংকটি ছিল পুরোনো ব্যবস্থাপনার অধীনে।

শেয়ারধারী ও আমানতকারীদের সংকট

ব্যাংকটি ২০২০ সাল থেকে কোনো লভ্যাংশ দিতে পারছে না। ফলে শেয়ারবাজারে এটি এখন ‘জেড’ শ্রেণির কোম্পানি হিসেবে তালিকাভুক্ত। অর্থাৎ, দুর্বল মানের এবং ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। মার্চ ২০২৫ পর্যন্ত তথ্য অনুযায়ী, ন্যাশনাল ব্যাংকের ৪৫ শতাংশের বেশি শেয়ার রয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে প্রায় ৩৯ শতাংশ এবং উদ্যোক্তা-পরিচালকদের হাতে মাত্র ১৬ শতাংশ। ফলে বিনিয়োগকারীদের বড় অংশই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

শুধু বিনিয়োগকারী নয়, অনেক আমানতকারীও এখন ব্যাংকে রাখা অর্থ ফেরত পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। ব্যাংকের তারল্য সংকটের কারণে অনেক আমানতের সময়মতো পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না।

লোকসানের ফলে কী কী ঝুঁকি রয়েছে?

ব্যাংকটির ধারাবাহিক লোকসানের ফলে এর মূলধন পর্যাপ্ততার হার (capital adequacy ratio) অনেক নিচে নেমে গেছে, যা বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের জন্য ঝুঁকির বার্তা বহন করে। এ ছাড়া আমানতকারীদের আস্থা হারানো, গ্রাহক সেবা ব্যাহত হওয়া এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার হস্তক্ষেপ আরও বাড়ার সম্ভাবনাও রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে ব্যাংকটির ওপর বিশেষ নজরদারি আরোপ করেছে এবং তারল্য সহায়তার কথাও ভাবছে বলে জানা গেছে। তবে এত বড় আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে হলে দীর্ঘমেয়াদি কাঠামোগত সংস্কার ছাড়া বিকল্প নেই বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

কীভাবে ফেরানো যাবে আস্থা?

অর্থনীতি বিশ্লেষক ও ঢাবির ব্যাংকিং বিশেষজ্ঞ ড. শাহনাজ হক বলেন, “ন্যাশনাল ব্যাংকের সমস্যার মূল হলো পরিচালনা কাঠামোর দুর্বলতা এবং ঋণ ব্যবস্থাপনার অনিয়ম। ব্যাংকটিকে স্থিতিশীল করতে হলে স্বচ্ছ নীতি, দায়িত্বশীল পরিচালনা এবং সময়োপযোগী তদারকি প্রয়োজন।”

তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংক যদি ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনায় কড়া নজরদারি বজায় রাখে এবং প্রয়োজনে পুনঃমূলধনী সহায়তা দেয়, তবে আস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব।”

ন্যাশনাল ব্যাংকের টানা তৃতীয় বছরের বিপুল লোকসান দেশের ব্যাংক খাতের স্বাস্থ্য নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে। বারবার পর্ষদ পরিবর্তন, পরিচালনায় অনিয়ম ও ঋণখেলাপির কারণে ব্যাংকটি গভীর সংকটে পড়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও নতুন পর্ষদকে একযোগে কার্যকর ও কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। নইলে ক্ষতির বোঝা সাধারণ বিনিয়োগকারী ও আমানতকারীদের ওপরই চাপবে আরও বেশি।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button