পাকিস্তান থেকে সব ধরনের আমদানি নিষিদ্ধ করল ভারত

কাশ্মীরের পেহেলগামে হামলার ঘটনায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নিল ভারত। সরাসরি ও পরোক্ষভাবে সব ধরনের আমদানি নিষিদ্ধ করেছে দিল্লি। জাতীয় নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক কূটনীতি কীভাবে এতে জড়িত, জেনে নিন বিস্তারিত।
কাশ্মীর হামলার প্রতিক্রিয়ায় ভারতের কড়া সিদ্ধান্ত
কাশ্মীরের পেহেলগামে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার পর পাকিস্তানকে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিকভাবে চাপে ফেলতে একের পর এক পদক্ষেপ নিচ্ছে ভারত। সর্বশেষ, পাকিস্তান থেকে সরাসরি ও পরোক্ষভাবে সব ধরনের পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করেছে ভারতের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়।
এই নিষেধাজ্ঞা তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর হয়েছে এবং পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে সরকারি নোটিশে জানানো হয়েছে।
কী ঘটেছিল কাশ্মীরে?
গত ২২ এপ্রিল, জম্মু ও কাশ্মীরের পেহেলগাম এলাকায় একটি ভয়াবহ সশস্ত্র হামলায় ২৬ জন নিহত হন, যাঁদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন দেশি-বিদেশি পর্যটক। ভারত এই হামলার জন্য পাকিস্তানের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীসমূহকে দায়ী করে। যদিও পাকিস্তান সরকার এই অভিযোগ সরাসরি নাকচ করেছে।
এই ঘটনার কয়েক দিনের মধ্যেই ভারত কঠোর বাণিজ্যিক পদক্ষেপ নিতে শুরু করে।
কী বলছে ভারত সরকার?
শুক্রবার প্রকাশিত সরকারি নোটিশে ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে—
“জাতীয় নিরাপত্তা ও জনস্বার্থ রক্ষার স্বার্থে পাকিস্তান থেকে সরাসরি কিংবা তৃতীয় দেশ হয়ে আসা সব ধরনের আমদানি নিষিদ্ধ করা হলো।”
ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্য বিভাগের (DGFT) পক্ষ থেকে জানানো হয়, কেউ যদি বিশেষ কারণে পাকিস্তান থেকে কোনো পণ্য আনতে চান, তাহলে সরকারের স্পষ্ট অনুমতি লাগবে।
নিষেধাজ্ঞার আওতায় কী কী?
এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়ছে:
- কৃষিপণ্য
- পোশাক ও কাঁচামাল
- ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম
- ক্রীড়াসামগ্রী
- প্রযুক্তিপণ্য
- এবং যেকোনো তৃতীয় দেশের মাধ্যমে পাকিস্তান থেকে আসা পরোক্ষ আমদানিও
বিশ্লেষকেরা বলছেন, নিষেধাজ্ঞার ফলে দুই দেশের মধ্যে সীমিত হলেও বিদ্যমান বাণিজ্যিক যোগাযোগ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে গেল।
অতীতেও ছিল আমদানি নিষেধাজ্ঞা
পুলওয়ামা হামলার (২০১৯) পরও ভারত পাকিস্তান থেকে আমদানির ওপর শুল্ক ২০০ শতাংশ করে দেয়, ফলে দুই দেশের মধ্যে কার্যত বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এই সাম্প্রতিক নিষেধাজ্ঞা সেই কড়াকড়িকে আরও একধাপ এগিয়ে নিল।
কেবল আমদানি নয়, কূটনৈতিক চাপও বাড়াচ্ছে ভারত
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, শুধু বাণিজ্যিক নয়, কূটনৈতিকভাবেও পাকিস্তানকে আন্তর্জাতিকভাবে চাপে ফেলার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে:
- পাকিস্তানকে আবার এফএটিএফ-এর গ্রে লিস্টে ফেরানোর জন্য প্রচেষ্টা
- বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের কাছে পাকিস্তানকে আর্থিক সহায়তা না দেওয়ার আবেদন
- পাকিস্তানের সন্ত্রাসে অর্থায়নের উৎস বন্ধে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা আহ্বান
এছাড়াও পাকিস্তানের সঙ্গে থাকা বহু চুক্তি পর্যালোচনা করে একাধিক চুক্তি বাতিল বা স্থগিত করেছে ভারত। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো সিন্ধু পানিচুক্তি—যার মাধ্যমে পাকিস্তান সিন্ধু নদীসহ বেশ কয়েকটি নদীর পানি পেয়ে থাকে।
পাকিস্তানের পাল্টা প্রতিক্রিয়া
ভারতের কড়াকড়ির জবাবে পাকিস্তান সরকার ‘সিমলা চুক্তি’ বাতিলের ঘোষণা দিয়েছে। ১৯৭২ সালে করা এই চুক্তির মাধ্যমে ভারত-পাকিস্তান শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে একমত হয়েছিল। এই চুক্তি বাতিল মানেই দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে উত্তেজনা বেড়ে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ইতোমধ্যে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সঙ্গে কথা বলেছেন।
তিনি দুই দেশকে আলোচনার মাধ্যমে উত্তেজনা প্রশমনের পরামর্শ দিয়েছেন এবং যেকোনো সামরিক উত্তেজনা এড়াতে কূটনৈতিক পথ বেছে নিতে অনুরোধ জানিয়েছেন।
ভারতের এই পদক্ষেপের সম্ভাব্য প্রভাব
- পাকিস্তানের অর্থনীতি চাপের মুখে পড়বে: আন্তর্জাতিক ঋণ সহায়তা ও রপ্তানি সীমিত হলে অর্থনীতির ওপর বড় ধাক্কা আসবে।
- আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ব্যাহত হতে পারে: রাজনৈতিক ও সামরিক উত্তেজনা বাড়লে পুরো দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে।
- বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও দুর্বল হবে: দীর্ঘমেয়াদে ভারত-পাকিস্তান মধ্যে সম্ভাব্য বাণিজ্য সম্ভাবনাও বিনষ্ট হতে পারে।
কাশ্মীরের পেহেলগামে প্রাণঘাতী হামলার পর পাকিস্তানের প্রতি ভারতের কঠোর পদক্ষেপ কেবল একটি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া নয়, বরং এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি কৌশলের অংশ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। কূটনৈতিক চাপ, বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা, চুক্তি স্থগিতকরণ—সবকিছু মিলিয়ে ভারত এখন পাকিস্তানকে আন্তর্জাতিকভাবে একঘরে করার প্রয়াসে রয়েছে।
তবে এই উত্তেজনা কতদিন স্থায়ী হবে এবং শেষ পর্যন্ত কোনো সমঝোতা আসবে কিনা, তা নির্ভর করছে উভয় দেশের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতায়।