অর্থনীতি

টানা দরপতনের পর সোনার বাজারে কিছুটা গতি

গত দুই সপ্তাহে বিশ্ববাজারে সোনার দাম উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। শুক্রবার (২ মে) শেষ হওয়া সপ্তাহে সোনার দাম কমেছে ২ দশমিক ৬ শতাংশের বেশি, যা গত দুই মাসের মধ্যে সবচেয়ে বড় দরপতনের একটি। তবে শনিবার (৩ মে) বিশ্ববাজারে কিছুটা দাম বেড়েছে, কারণ অনেক বিনিয়োগকারী ‘বার্গেইন হান্টিং’-এর সুযোগ কাজে লাগাতে বাজারমুখী হয়েছেন।

বিশ্ববাজারে সোনার দামের এই পতন এবং সাময়িক পুনরুদ্ধার নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। কেউ কেউ বাজারে স্থিতিশীলতার প্রত্যাশা করছেন, আবার কেউ দীর্ঘমেয়াদে সোনার সম্ভাবনার দিকেই নজর রাখছেন।

সর্বশেষ মূল্য পরিস্থিতি

রয়টার্সগোল্ড প্রাইস ডট অর্গ সূত্রে জানা গেছে, শুক্রবার স্পট মার্কেটে সোনার দাম ০.৪% কমে দাঁড়ায় প্রতি আউন্সে ৩,২২৮.৫০ ডলার। এটি গত দুই সপ্তাহের মধ্যে সর্বনিম্ন। অথচ মাত্র দুই সপ্তাহ আগেই, ২২ এপ্রিল, সোনার দাম ইতিহাসের সর্বোচ্চ ৩,৫০০ ডলার স্পর্শ করেছিল।

তবে ফিউচার মার্কেটে শুক্রবার ইউএস গোল্ড ফিউচারের দাম ০.৬% বেড়ে ৩,২৪৩.৩০ ডলারে উঠে আসে। এতে বোঝা যায়, অনেক বিনিয়োগকারী দাম কমার পর তা কিনে রাখছেন ভবিষ্যতের সম্ভাব্য চাহিদা ও মুনাফার আশায়।

কেন কমছে সোনার দাম?

বিশ্লেষকেরা বলছেন, মূলত তিনটি কারণে সোনার দাম কমেছে:

  1. যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য আলোচনায় অগ্রগতি: মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের চীনকে নিয়ে শুল্ক আলোচনা শুরু করার ঘোষণার পর থেকেই বিশ্ববাজারে কিছুটা স্থিতিশীলতা ফিরেছে। এই স্থিতিশীলতা ‘নিরাপদ আশ্রয়’ হিসেবে সোনার চাহিদা কমিয়ে দিয়েছে।
  2. বিনিয়োগকারীদের ধৈর্য: সোনার দাম রেকর্ড উচ্চতায় যাওয়ার পর অনেক বিনিয়োগকারী লাভ তুলে নিতে বিক্রিতে ঝুঁকেছেন, যার ফলে মূল্য কমেছে।
  3. ডলার শক্তিশালী হওয়া: সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন ডলারের মান কিছুটা বেড়েছে, যা আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার দামে প্রভাব ফেলেছে। ডলার শক্ত হলে সোনার বিনিময়মূল্য অনুপাতিক হারে কমে যায়।

দাম কমলেও চাহিদা থেকে যাচ্ছে

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সোনার দাম কমলেও এর মৌলিক চাহিদা এখনো শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। বিশ্বজুড়ে অনিশ্চয়তা, যুদ্ধ, মুদ্রাস্ফীতি এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা সোনার প্রতি দীর্ঘমেয়াদি আগ্রহ বজায় রাখছে।

বার্গেইন হান্টিং—এই পরিভাষা বর্তমানে সোনার বাজারে আলোচিত। অনেক বিনিয়োগকারী এই কম দামে সোনা কিনে ভবিষ্যতের চাহিদা ও দামের সম্ভাব্য বৃদ্ধির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাস: কী বলছে বিশ্লেষণ?

বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাক্স পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ সোনার দাম আউন্সপ্রতি ৩,৭০০ ডলারে উঠতে পারে। পূর্বে তারা যে পূর্বাভাস দিয়েছিল তা ছিল ৩,৩০০ ডলার। এমনকি আগামী মাসগুলোতে সোনার দাম ৩,৬৫০ থেকে ৩,৯৫০ ডলার সীমার মধ্যে ঘোরাফেরা করতে পারে বলে জানানো হয়েছে।

এই পূর্বাভাসের পেছনে প্রধান দুটি কারণ তুলে ধরা হয়েছে:

  1. কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সোনার মজুদ বৃদ্ধির প্রবণতা
  2. সোনাভিত্তিক ইটিএফ তহবিলে বিনিয়োগ বৃদ্ধি

এই দুই কারণে দীর্ঘমেয়াদে সোনার বাজারকে স্থিতিশীল ও লাভজনক বলে বিবেচনা করা হচ্ছে।

সোনার দামের ওপর প্রভাব ফেলা অন্যান্য কারণসমূহ

  • মধ্যপ্রাচ্য সংকট ও ইউক্রেন যুদ্ধ: বিশ্বজুড়ে ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা সোনাকে একটি নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে তুলে ধরছে।
  • মুদ্রাস্ফীতি ও সুদের হার: যুক্তরাষ্ট্রে সুদের হার সামান্য কমতে শুরু করেছে, যা সোনার বাজারে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
  • ক্রিপ্টোকারেন্সির সাথে তুলনা: অনেক বিনিয়োগকারী এখনো সোনা ও বিটকয়েনের মধ্যে তুলনা করে দেখছেন, তবে সোনার স্থিতিশীলতাই অনেকের কাছে ভরসার জায়গা।

বাংলাদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য বার্তা

বাংলাদেশে সোনার বাজার আন্তর্জাতিক দামের প্রভাব সরাসরি গ্রহণ করে। ফলে বিশ্ববাজারে সোনার দরপতন দেশের বাজারেও প্রভাব ফেলবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ সংকট এবং টাকার অবমূল্যায়নের কারণে স্থানীয় বাজারে তাৎক্ষণিক কম দামে সোনা পাওয়া যাবে না।

বাংলাদেশের স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা বরাবরই বিশ্ববাজারে দাম কমলে কিছুদিন পর সেটি বাস্তবায়ন করে থাকেন। ফলে সাধারণ ক্রেতাদের জন্য কম দামে সোনা কেনার সুযোগ তৈরি হতে পারে।

সোনার বাজারে টানা দুই সপ্তাহের দরপতন অস্থায়ী হলেও এতে ভবিষ্যতের বিনিয়োগ সম্ভাবনা ক্ষুণ্ণ হয়নি। বরং বর্তমান পরিস্থিতিকে অনেক বিনিয়োগকারী একটি ‘সুযোগ’ হিসেবে দেখছেন। যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য আলোচনার সফলতা, মুদ্রানীতির পরিবর্তন এবং বিশ্বব্যাপী অনিশ্চয়তা সোনার দামে ওঠানামা ঘটাতে পারে।

তবে সামগ্রিক বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, সোনার প্রতি দীর্ঘমেয়াদে আস্থা এখনো অটুট। ফলে সতর্ক দৃষ্টিভঙ্গি ও সঠিক সময় চিহ্নিত করে বিনিয়োগকারীরা লাভবান হতে পারেন।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button