বিকাশের ৩১৬ কোটি টাকার রেকর্ড মুনাফা, ১০ বছরে বেড়ে ১৭ গুণ

বাংলাদেশের মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) খাতের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান বিকাশ ২০২৪ সালে প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে সর্বোচ্চ আয় ও মুনাফা অর্জন করেছে। প্রতিষ্ঠানটির বাৎসরিক মুনাফা প্রথমবারের মতো ৩১৬ কোটি টাকা ছুঁয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ২১৯ শতাংশ বেশি। একই সঙ্গে বিকাশের মোট আয় ৫ হাজার ৫৮ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে, যা এক বছরে ২১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নির্দেশ করে।
এই অসাধারণ আর্থিক সাফল্যের তথ্য প্রকাশ পায় ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান বিকাশ লিমিটেডের সদ্য প্রকাশিত আর্থিক প্রতিবেদনে।
এক নজরে বিকাশের আর্থিক অগ্রগতি
বছর | মোট আয় (কোটি টাকা) | মোট মুনাফা (কোটি টাকা) |
---|---|---|
২০১৪ | ৫৭৩ | ১৯ |
২০২৩ | ৪১৯১ | ৯৯ |
২০২৪ | ৫০৫৮ | ৩১৬ |
মাত্র ১০ বছরে বিকাশের আয় বেড়েছে ৯ গুণ, আর মুনাফা বেড়েছে ১৭ গুণ। ২০১৪ সালে যেখানে কোম্পানির মুনাফা ছিল ১৯ কোটি টাকা, ২০২৪ সালে সেই অঙ্ক পৌঁছেছে ৩১৬ কোটিতে।
বিকাশের আয়ের গতিপথ: ধারাবাহিকতা ও দৃষ্টান্ত
২০১১ সালে যাত্রা শুরু করা বিকাশ শুরুর দিকেই জনসাধারণের মধ্যে মোবাইলের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেনের ধারণা জনপ্রিয় করে তোলে। প্রতিষ্ঠার এক দশকের মধ্যেই বিকাশ পরিণত হয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় এমএফএস ব্র্যান্ডে।
২০২৪ সালে প্রতিষ্ঠানটির আয় আগের বছরের তুলনায় ৮৬৭ কোটি টাকা বেড়েছে। ২০২৩ সালে আয় ছিল ৪ হাজার ১৯১ কোটি টাকা, আর ২০২৪ সালে তা দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৫৮ কোটি টাকায়।
এর পাশাপাশি ২০২১ সালে বিকাশের লোকসান ছিল ১১৭ কোটি টাকা, সেখান থেকে মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে ৩১৬ কোটি টাকার রেকর্ড মুনাফা—এটি শুধু বিকাশের জন্য নয়, দেশের ডিজিটাল আর্থিক খাতের জন্যও এক বড় অর্জন।
মুনাফার এই উল্লম্ফনের পেছনের কারণ কী?
বিকাশের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (CFO) মঈনুদ্দিন মোহাম্মদ রাহগীর বলেন, “বিকাশ সবসময় ব্যবসাকে টেকসই করার লক্ষ্যে দীর্ঘমেয়াদি পুঁজি বিনিয়োগ করে আসছে। প্রযুক্তি, অবকাঠামো ও গ্রাহক শিক্ষা—এই তিন খাতে ধারাবাহিক বিনিয়োগই রাজস্ব প্রবৃদ্ধি ও মুনাফায় স্থিতিশীলতা এনেছে।”
তিনি আরও বলেন, “ক্যাশলেস বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে আমরা এক দশক ধরে কাজ করছি। এর সুফল আমরা এখন পাচ্ছি।”
ব্র্যাক ব্যাংকের রেকর্ড মুনাফায় বিকাশের অবদান
বিকাশের এই রেকর্ড মুনাফার প্রভাব পড়েছে এর মূল অংশীদার ব্র্যাক ব্যাংক-এর উপার্জনেও। ২০২৪ সালে ব্র্যাক ব্যাংকের সমন্বিত মুনাফা ছিল ১ হাজার ৪৩২ কোটি টাকা, যার বড় একটি অংশ এসেছে বিকাশের লাভ থেকে।
ব্র্যাক ব্যাংকের মালিকানায় থাকা এই ডিজিটাল লেনদেন প্ল্যাটফর্মটি শুধু প্রযুক্তিগত নয়, আর্থিকভাবে ব্যাংকের সবচেয়ে লাভজনক অংশীদার প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
বিনিয়োগ, শিক্ষা ও প্রযুক্তি: বিকাশের বৃদ্ধির মূল ভিত্তি
বিকাশের বিস্তার হয়েছে দেশের সব স্তরের মানুষের মধ্যে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির রয়েছে:
- প্রায় ৮ কোটি গ্রাহক
- ৩ লাখ ৩০ হাজার এজেন্ট
- ৫.৫ লাখ মার্চেন্ট পয়েন্ট
এর পাশাপাশি ন্যানো ঋণ, বিল পরিশোধ, ডিপোজিট সুবিধা সহ আরও নানা ডিজিটাল সেবা রয়েছে বিকাশে। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, ভবিষ্যতে আরও নতুন ফিচার ও আর্থিক পণ্য যুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে।
লোকসান থেকে লাভে ফেরার গল্প
বিকাশ ২০১৪ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত ধারাবাহিক মুনাফা করলেও ২০১৮ সালে সেই ধারায় ছেদ পড়ে। এরপর ২০১৯-২০২১ সাল পর্যন্ত তিন বছর কোম্পানিটি লোকসানে ছিল। বিশেষ করে ২০২১ সালে ১১৭ কোটি টাকার বিশাল লোকসান তাদের জন্য একটা সতর্কবার্তা হিসেবে কাজ করে।
কিন্তু পরিকল্পিত প্রযুক্তি উন্নয়ন, সেবা বিস্তার ও দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের ফলে ২০২২ সালে ১৮ কোটি টাকা, ২০২৩ সালে ৯৯ কোটি টাকা এবং ২০২৪ সালে ৩১৬ কোটি টাকার মুনাফা—এটি বিকাশের কার্যকর পুনরুদ্ধারের দৃষ্টান্ত।
বিকাশের বিনিয়োগকারীগণ ও বৈশ্বিক সহায়তা
বিকাশের পেছনে রয়েছে শক্তিশালী বিনিয়োগ কাঠামো। এর মালিকানায় অংশীদার:
- ব্র্যাক ব্যাংক (Bangladesh)
- মানি ইন মোশন (যুক্তরাষ্ট্র)
- আইএফসি (International Finance Corporation, World Bank Group)
- বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন
- অ্যান্ট ইন্টারন্যাশনাল (Alibaba Group)
- সফটব্যাংক (জাপান)
এই বিনিয়োগকারীদের সম্মিলিত আর্থিক, প্রযুক্তিগত ও কৌশলগত সহায়তা বিকাশকে দেশের আর্থিক অন্তর্ভুক্তির অন্যতম চালিকাশক্তিতে পরিণত করেছে।
সরকারি কর ও ব্যাংক সুদ: আরও একধাপ স্বচ্ছতা
বিকাশ ২০২৪ সালে সরকারকে কর হিসেবে দিয়েছে ১৮৯ কোটি টাকা। পাশাপাশি ব্যাংক থেকে সুদ বাবদ আয় করেছে ১৯০ কোটি টাকা। এটি প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক ব্যবস্থাপনার দক্ষতা ও স্বচ্ছতা নির্দেশ করে।
বিকাশ এখন দেশের সবচেয়ে লাভজনক ডিজিটাল ফিনান্স প্ল্যাটফর্ম
বিকাশ এখন আর কেবল একটি এমএফএস কোম্পানি নয়, এটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ডিজিটালাইজেশনের কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে আছে। ১০ বছরের অগ্রগতিতে ১৭ গুণ মুনাফা বৃদ্ধির এই সফলতা প্রমাণ করে যে, প্রযুক্তি নির্ভর আর্থিক সেবার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। টেকসই বিনিয়োগ, উদ্ভাবন এবং আর্থিক অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে বিকাশ আগামী বছরগুলোতেও আরও বড় অগ্রগতি দেখাবে বলে আশা করা হচ্ছে।