অর্থনীতি

সস্তা শ্রমের তিন খাতই অর্থনীতির মেরুদণ্ড

বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুত এগিয়ে চললেও এর পেছনের মূল শক্তি—শ্রমিকরা—আজ দুর্দশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। কৃষি, তৈরি পোশাক শিল্প এবং প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স—এই তিন খাত দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হিসেবে বিবেচিত। এই খাতগুলোর উন্নতির পেছনে রয়েছে শ্রমিকদের অক্লান্ত পরিশ্রম। কিন্তু সস্তা শ্রমের ওপর নির্ভরশীল এই খাতগুলোতে শ্রমিকরা ন্যায্য মজুরি, নিরাপদ কর্মপরিবেশ এবং মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপন থেকে বঞ্চিত। প্রতি বছর মে দিবসে শ্রমিকদের এই দুর্দশা আলোচনায় আসে, কিন্তু বছর শেষে সমস্যা সমাধানে কার্যকর কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এবং বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এই তথ্য পাওয়া গেছে।

শ্রমিকদের অবদান: অর্থনীতির চালিকাশক্তি

বাংলাদেশের অর্থনীতির তিনটি মৌলিক খাত—কৃষি, তৈরি পোশাক এবং রেমিট্যান্স—দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) উল্লেখযোগ্য অংশে অবদান রাখে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুসারে, চলতি অর্থবছরে জিডিপির আকার ৫৫ লাখ কোটি টাকা, যার মধ্যে কৃষি খাতের অবদান ১৩ শতাংশ, শিল্প খাতের ৩৩ শতাংশ এবং সেবা খাতের ৫৬ শতাংশ। এর সঙ্গে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স যোগ হলে জাতীয় আয় আরও বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে মাথাপিছু আয় ২,৭৮৪ মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশকে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের কাতারে রেখেছে।

কৃষি খাতে প্রায় ৪০ শতাংশ শ্রমিক কাজ করেন, যারা দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করছেন। তৈরি পোশাক শিল্প, যা বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানিকারক, প্রায় ৫০ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে। ২০২৩ সালে এই খাত থেকে ৫৪ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যা জিডিপির ১০ শতাংশ। অন্যদিকে, প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শক্তিশালী করছে। এই তিন খাতের সাফল্যের পেছনে শ্রমিকদের অবদান অপরিসীম। কিন্তু প্রশ্ন হলো, শ্রমিকরা কি তাদের প্রাপ্য অধিকার পাচ্ছেন?

শ্রমিকদের দুর্দশা: কম মজুরি, অনিরাপদ কর্মপরিবেশ

শ্রমিকদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো ন্যায্য মজুরির অভাব। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পেরিয়ে গেলেও বাংলাদেশে জাতীয় মজুরি কমিশন গঠিত হয়নি। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা অনুসারে, দেশের মোট শ্রমিকের ৮৫ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন, যেখানে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারিত নেই। প্রাতিষ্ঠানিক খাতের ৫৮টি পেশায় ন্যূনতম মজুরি থাকলেও, ১৪২টি খাত-উপখাতের মধ্যে ৮৪টিতে কোনো ন্যূনতম মজুরি নেই। তৈরি পোশাক খাতে সর্বনিম্ন মজুরি ১২,৫০০ টাকা নির্ধারিত হলেও, অনেক ছোট ও মাঝারি কারখানায় এই মজুরি বাস্তবায়ন হয় না।

কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার অভাব আরেকটি গুরুতর সমস্যা। শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন অনুসারে, গত এক দশকে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ৮,২৯৮ জন শ্রমিক নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে ২০২৪ সালেই মারা গেছেন ৮২০ জন। এছাড়া, ১৯৯০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত তৈরি পোশাক কারখানায় ৩৩টি বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শ্রমিকরা যথাযথ ক্ষতিপূরণ পাননি। স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি, দীর্ঘ কাজের সময় এবং অতিরিক্ত কাজের জন্য মজুরি না পাওয়াও শ্রমিকদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে।

আয় বৈষম্য: দানবীয় রূপ

বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার বাড়লেও আয় বৈষম্য ক্রমশ ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে। শ্রম সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট অনুসারে, ২০২১ সালের জরিপে দেখা গেছে, দেশের সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ মানুষ জাতীয় আয়ের ৪৪ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করেন, যার মধ্যে শীর্ষ ১ শতাংশের আয় ১৬.৩ শতাংশ। অন্যদিকে, পিছিয়ে থাকা ৫০ শতাংশ মানুষের আয় মাত্র ১৭.১ শতাংশ। এই বৈষম্যের পরিমাপক গিনি সহগ বাংলাদেশে উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৫ সালে দেশে অতিদরিদ্র মানুষের সংখ্যা ১ কোটি ৫৮ লাখে পৌঁছাতে পারে, যা গত বছরের তুলনায় ৩০ লাখ বেশি। মানুষের প্রকৃত আয় কমে যাওয়া, দুর্বল শ্রমবাজার এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের নিম্নগতি এর প্রধান কারণ।

বেকারত্ব: ক্রমবর্ধমান সংকট

বাংলাদেশে শ্রমশক্তির সংখ্যা ৭ কোটি ৩৪ লাখ, যার মধ্যে প্রতি বছর ২২ লাখ নতুন শ্রমিক বাজারে প্রবেশ করছেন। কিন্তু সিপিডির হিসাবে, আনুষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত মিলিয়ে বছরে মাত্র ৬ লাখ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে বাকি শ্রমিকরা বেকার থেকে যাচ্ছেন। বিবিএসের তথ্য অনুসারে, বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৩০ হাজার, যদিও বেসরকারি গবেষণা সংস্থাগুলো দাবি করছে, প্রকৃত বেকারের সংখ্যা ৪ কোটির বেশি। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মানদণ্ড অনুসারে, সপ্তাহে এক ঘণ্টাও কাজ না পেলে ব্যক্তিকে বেকার হিসেবে গণ্য করা হয়। করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং মধ্যপ্রাচ্যের সংকট বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মন্দা সৃষ্টি করেছে, যার প্রভাবে প্রবাসী শ্রমিকরাও কাজ হারাচ্ছেন।

বিশেষজ্ঞদের মতামত ও সমাধানের পথ

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, “করোনা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা অর্থনীতির গতিপথ পালটে দিয়েছে। শ্রমিকদের জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে।” তিনি শিক্ষার মান বৃদ্ধি, দক্ষতা উন্নয়ন এবং বিনিয়োগের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টির ওপর জোর দেন। তিনি সতর্ক করে বলেন, “কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হলে জনশক্তি বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।”

বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের অর্থ সম্পাদক কাজী মো. রুহুল আমিন বলেন, “কৃষি ও শিল্প খাতের শ্রমিকরা চরম বঞ্চনার শিকার। ন্যূনতম মজুরি ৩০ হাজার টাকা করা, শ্রম সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন এবং সর্বজনীন রেশন ব্যবস্থা চালু করা জরুরি।” তিনি শ্রম আইন সংশোধনের মাধ্যমে আইএলও কনভেনশন মেনে চলার দাবি জানান।

শ্রম সংস্কার কমিশনের সুপারিশ

অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত শ্রম সংস্কার কমিশন সম্প্রতি ২৫টি সুপারিশসহ একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে জাতীয় ন্যূনতম মজুরি কাঠামো নির্ধারণ, মজুরি বোর্ডের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং তিন বছর পরপর খাতভিত্তিক মজুরি মূল্যায়ন। প্রতিবেদনে বলা হয়, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কোনো পেশায় জাতীয় মজুরি নেই, যা শ্রমিকদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

উপসংহার

বাংলাদেশের অর্থনীতি শ্রমিকদের পরিশ্রমের ওপর দাঁড়িয়ে থাকলেও তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপের অভাব রয়েছে। ন্যায্য মজুরি, নিরাপদ কর্মপরিবেশ এবং বৈষম্য হ্রাসে সরকার, শিল্প মালিক এবং ট্রেড ইউনিয়নের সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। শ্রম সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন এবং জাতীয় মজুরি কমিশন গঠনের মাধ্যমে শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব। মে দিবস কেবল আলোচনার দিন নয়, শ্রমিকদের প্রতি প্রকৃত দায়বদ্ধতা প্রকাশের সময়।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button