অর্থনীতি

গ্যাস নেই, বিদ্যুৎ নেই তবু কর চাই সরকার

বিনিয়োগ নেই, গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট তীব্র, উৎপাদন খাত থমকে দাঁড়িয়েছে—এর মাঝেও রাজস্ব আদায়ে সরকার পিছপা নয়। করছাড়ের দিন শেষ বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। আর এই বার্তা এসেছে এমন এক সময়ে, যখন শিল্প উদ্যোক্তারা নিয়মিত ঘুষ, হয়রানি, ও অনুৎপাদনশীল প্রশাসনিক জটিলতার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন।

রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে বুধবার (৩০ এপ্রিল) জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের পরামর্শক কমিটির ৪৫তম বৈঠকে মুখোমুখি হন সরকারের অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা, কর প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা এবং বেসরকারি খাতের নেতৃস্থানীয় শিল্প উদ্যোক্তারা। এ সভায় পরিণত হয় কর প্রশাসনের কঠোর অবস্থান বনাম ব্যবসায়ীদের ক্ষোভের মঞ্চে।

ঘুষ ছাড়া কর দেওয়া যাচ্ছে না: ব্যবসায়ীদের ক্ষোভ

বৈঠকে বিস্ফোরক অভিযোগ তোলেন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ। তিনি বলেন, “৩০ হাজার টাকার শুল্ক দিতে গেলে ৫০ হাজার টাকা ঘুষ লাগে।” বিনিয়োগকারীরা নিয়ম মেনে কর দিতে চাইলেও প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ তার।

একইসঙ্গে, মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল বলেন, “কুমিল্লা ইকোনমিক জোনে আমরা ৬০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছি, কিন্তু দুই বছরেও গ্যাস ও বিদ্যুৎ পাইনি।” তার মতে, দেশের বিনিয়োগকারীদের এইভাবে অবহেলা করে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের চেষ্টা নীতিগতভাবে ভুল।

ভ্যাট-সংক্রান্ত জটিলতা নিয়ে বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম অভিযোগ করেন, “ব্যবসায়ীদের অহেতুক হয়রানি করতে নানা অপ্রয়োজনীয় কাগজপত্র দাবি করেন কর কর্মকর্তারা।” বিশেষ করে সোলার প্যানেল ও ইনভার্টারের ওপর উচ্চ শুল্ক হারও জ্বালানি সংকট কাটাতে উদ্যোক্তাদের বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

সরকারের স্পষ্ট বার্তা: করছাড় নয়, বাস্তবায়নযোগ্য বাজেট

অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ তাঁর বক্তব্যে স্পষ্টভাবে বলেন, “করছাড়ের দিন শেষ। এখন কর দিয়ে সুবিধা নিতে হবে।” তিনি জানান, রাজস্ব আদায়ের ব্যাপারে সরকারের ওপর তীব্র চাপ রয়েছে এবং বাজেট হবে বাস্তবায়নযোগ্য পরিকল্পনায় তৈরি, কোনো ফুলঝুরির প্রতিশ্রুতি নয়।

তিনি আরও বলেন, “ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্কনীতির মতোই আমাদের প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকতে হলে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক কর কাঠামো গড়ে তুলতে হবে।” এ কথার মাধ্যমে তিনি আভাস দেন, আন্তর্জাতিক চাপ ও অভ্যন্তরীণ সংকট মোকাবেলায় কর আদায়কে আর শিথিল রাখা যাবে না।

করব্যবস্থার ডিজিটাইজেশন ও অটোমেশন: এনবিআরের আশ্বাস

এনবিআরের চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান করপোরেট কর হার কমানোর সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়ে বলেন, “করব্যবস্থার ডিজিটাইজেশনে আমরা জোর দিচ্ছি।” তিনি জানান, করপ্রদান প্রক্রিয়াকে সহজ ও স্বচ্ছ করতে অটোমেশন প্রকল্পে বন্ড ব্যবস্থাও চালু করা হচ্ছে।

করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোর দাবি ও উৎসে কর হ্রাসের প্রস্তাব

এফবিসিসিআইয়ের পক্ষ থেকে সাধারণ করদাতার করমুক্ত আয়সীমা ৩.৫ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪.৫ লাখ টাকা করার দাবি জানানো হয়। সংগঠনের প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমান বলেন, “মূল্যস্ফীতি ও জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে বর্তমান কর কাঠামো সাধারণ মানুষকে দুর্বিষহ করে তুলেছে।”

তিনি আরও প্রস্তাব করেন, রপ্তানি খাতে উৎসে কর ১ শতাংশ থেকে কমিয়ে ০.৫ শতাংশ করা হোক এবং তা অন্তত পাঁচ বছরের জন্য স্থায়ী করা হোক।

বাণিজ্য উপদেষ্টার হুঁশিয়ারি: বাস্তবতার ভিত্তিতে বাজেট

বৈঠকে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, “এবারের বাজেট হবে ব্যয়ের উন্মাদনায় নয়, বাস্তবতার ভিত্তিতে তৈরি লক্ষ্যনির্ভর এক নথি।” তিনি জানান, সরকার বাজেটে জনস্বার্থে টেকসই এবং বাস্তবমুখী পরিকল্পনা নেবে।

অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ তার বক্তব্যে আইএমএফ ঋণ নিয়ে সরকার উদ্বিগ্ন নয় বলেও জানান। তিনি বলেন, “সামষ্টিক অর্থনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে।”

একটি সভা নয়, গোটা অর্থনীতির প্রতিবিম্ব

এই আলোচনা সভা একটি কক্ষের সীমায় আবদ্ধ ছিল না—এটি বাংলাদেশের চলমান অর্থনৈতিক বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। রাষ্ট্র চায় কর, ব্যবসায়ী চান স্বচ্ছতা। কিন্তু যদি পারস্পরিক আস্থার ভিত্তিতে করব্যবস্থা গড়ে না ওঠে, তবে রাজস্ব আদায় হবে জোরপূর্বক, এবং শিল্প-বিনিয়োগ আরও সংকুচিত হয়ে পড়বে।

২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটের প্রাক্কালে এনবিআর ও এফবিসিসিআইয়ের এই দ্বন্দ্বমুখর পরামর্শ সভা একটি গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত দিচ্ছে: কর নীতির কড়াকড়ি বাড়লেও ব্যবসায়ী ও সাধারণ করদাতার দুর্ভোগ কমেনি। এই বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে যদি সরকার একটি ভারসাম্যপূর্ণ বাজেট উপস্থাপন করতে পারে, তবেই অর্থনীতির কাঙ্ক্ষিত উত্তরণ সম্ভব হবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button