অর্থনীতি

পুঁজিবাজারে আস্থা ফেরাতে একগুচ্ছ পদক্ষেপ নেবে বিএসইসি

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে শেয়ারের দরপতন ও বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতা বেশ গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে দেশের শেয়ারবাজারকে স্থিতিশীল করতে এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধার করতে একগুচ্ছ তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

গতকাল মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত এক জরুরি বৈঠকে বিএসইসি এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আনিসুজ্জামান চৌধুরী, বিএসইসি চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ, কমিশনার মু. মোহসিন চৌধুরী, মো. আলী আকবর, ফারজানা লালারুখ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেক এবং যুগ্ম সচিব দেলোয়ার হোসেনসহ সংশ্লিষ্ট টাস্কফোর্সের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।

বাজার বিশ্লেষণ ও তদারকি জোরদার

সভায় জানানো হয়, সাম্প্রতিক শেয়ারবাজার পতনের প্রকৃত কারণ চিহ্নিত করে তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বিএসইসি। বিশেষ করে যেসব শেয়ারের ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক বিক্রির চাপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে, সেসব শেয়ারের গতিবিধি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে প্রয়োজনীয় তদন্ত ও হস্তক্ষেপ করা হবে।

পুঁজিবাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে বাজারে স্বচ্ছতা ও কার্যকর নজরদারি জোরদারের বিষয়টিও গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করা হয়। এতে শেয়ারবাজারে অযৌক্তিক গুজব রটনা ও কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির প্রবণতা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বিনিয়োগ শিক্ষা ও গণসচেতনতা

বিনিয়োগকারীদের জ্ঞান ও সচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে টেলিভিশন, ইউটিউব এবং ফেসবুকের মতো গণমাধ্যমে পুঁজিবাজার-সংক্রান্ত টক শো ও শিক্ষামূলক ভিডিও প্রচারের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ক্যাপিটাল মার্কেট (বিআইসিএম) ও বিএসইসির সহযোগী বিএএসএম পুঁজিবাজারবিষয়ক শিক্ষণীয় কনটেন্ট প্রস্তুত করবে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইতিবাচক বার্তা প্রচার করে সাধারণ মানুষকে বিনিয়োগে আগ্রহী ও সচেতন করার পরিকল্পনা রয়েছে বিএসইসির। এর মাধ্যমে একটি শক্তিশালী ও তথ্যভিত্তিক বিনিয়োগ পরিবেশ গড়ে তোলার আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন কমিশনের কর্মকর্তারা।

মৌলভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানিকে তালিকাভুক্তির উদ্যোগ

পুঁজিবাজারকে আরো শক্তিশালী করতে আইপিওর মাধ্যমে দেশি-বিদেশি লাভজনক ও মৌলভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্ত করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এতে যেমন বাজারে ভালো শেয়ারের সরবরাহ বাড়বে, তেমনি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থাও তৈরি হবে।

এই উদ্যোগের আওতায়:

  • রাষ্ট্রমালিকানাধীন লাভজনক কোম্পানিগুলোর শেয়ার বাজারে অফলোড করা হবে।
  • বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্তিতে উৎসাহিত করা হবে।
  • দেশীয় টেক্সটাইল ও ওষুধ শিল্পের লাভজনক কোম্পানিগুলোর শেয়ার বাজারে আনার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এই পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়িত হলে বাজারে মানসম্পন্ন শেয়ারের সংখ্যা বাড়বে এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা দীর্ঘমেয়াদে সুদৃঢ় হবে।

করছাড় ও দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের সুযোগ

পুঁজিবাজারে নতুন কোম্পানি আনার লক্ষ্যে করছাড়ের মতো আকর্ষণীয় প্রণোদনা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত না হওয়া কোম্পানিগুলো উৎসাহিত হবে।

একই সঙ্গে ব্যাংকিং খাতের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে পুঁজিবাজারকে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের প্রধান উৎস হিসেবে গড়ে তোলার পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এই কাঠামো বাস্তবায়িত হলে শিল্প ও অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ বাড়বে।

বাজেটে বিনিয়োগবান্ধব প্রস্তাব

আসন্ন জাতীয় বাজেটে বিনিয়োগকারীদের জন্য করছাড় সুবিধার সুপারিশ করেছে বিএসইসি। প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে:

  • লভ্যাংশ আয়ের ওপর করছাড়
  • পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ওপর বিশেষ কর ছাড়

এই ধরনের কর প্রণোদনা বিনিয়োগকে আকর্ষণীয় করে তুলবে এবং মধ্যম আয়ের ব্যক্তিদের পুঁজিবাজারমুখী করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে।

নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় বাড়ানো হবে

সভায় একমত প্রকাশ করা হয় যে, পুঁজিবাজারের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের জন্য কেবল বিএসইসি এককভাবে নয়, বরং অন্যান্য আর্থিক নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, এবং অন্যান্য সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় জোরদার করে পুঁজিবাজারকে আরও সুসংহত এবং টেকসই করে গড়ে তোলা হবে।

বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে বিএসইসির গৃহীত পদক্ষেপগুলো বাজারে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। বাজার তদারকি, শিক্ষামূলক কার্যক্রম, মৌলভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানির তালিকাভুক্তি ও করছাড়ের মতো বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার আবারও চাঙা হয়ে উঠতে পারে।

যদিও দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন সময়সাপেক্ষ, তবে এই পদক্ষেপগুলোর কার্যকর বাস্তবায়নই নির্ধারণ করবে বাজারের ভবিষ্যৎ গতি। বিনিয়োগকারীদের জন্য এখন প্রয়োজন সচেতনতা ও ধৈর্যের সঙ্গে বাজার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button