ব্র্যাক ব্যাংকের ইতিহাস গড়া মুনাফা: এক বছরে নিট লাভ ১,৪৩২ কোটি টাকা

২০২৪ সালটি দেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য ছিল এক অবিশ্বাস্য অর্জনের বছর। বেসরকারি খাতের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক ব্যাংক ইতিহাস গড়ে বছরের শেষে এককভাবে ১,২১৪ কোটি টাকা এবং সহযোগী প্রতিষ্ঠানসহ মোট ১,৪৩২ কোটি টাকার নিট মুনাফা অর্জন করেছে। এটি ব্যাংকটির ইতিহাসে সর্বোচ্চ এবং দেশের ব্যাংকিং খাতেও নজিরবিহীন ঘটনা।
এই অর্জন কেবল ব্যাংকটির জন্যই নয়, বরং সমগ্র দেশীয় ব্যাংকিং খাতের জন্য একটি বড় মাইলফলক। অতীতে কোনো দেশীয় মালিকানাধীন ব্যাংক এত বড় পরিমাণ মুনাফা অর্জন করতে পারেনি।
আগের বছরের তুলনায় মুনাফা বেড়েছে ৭৩ শতাংশ
২০২৩ সালে ব্র্যাক ব্যাংকের নিট মুনাফা ছিল ৭৩০ কোটি টাকা, আর সমন্বিত মুনাফা ছিল ৮২৭ কোটি টাকা। সেখান থেকে ২০২৪ সালে একক মুনাফা বেড়েছে ৪৮৪ কোটি টাকা বা ৬৬ শতাংশ, আর সমন্বিত মুনাফা বেড়েছে ৬০৫ কোটি টাকা বা ৭৩ শতাংশ। এক বছরে এমন মুনাফা প্রবৃদ্ধি ব্র্যাক ব্যাংকের ইতিহাসে এই প্রথম।
কেন এই রেকর্ড মুনাফা?
ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন জানিয়েছেন, “করোনার পর আমরা ধারাবাহিকভাবে ব্যবসায় উন্নতি করেছি। ২০২৪ সালে আমাদের আমানত প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩২ শতাংশ এবং ঋণ প্রবৃদ্ধি ২০ শতাংশের বেশি। এটি দেশের ব্যাংক খাতে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধির একটি উদাহরণ।”
তিনি আরও বলেন, “বাজারে অনেক ব্যাংকের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্বল ব্যবস্থাপনার অভিযোগ থাকলেও, ব্র্যাক ব্যাংক সুশাসন ও নির্ভরতার কারণে গ্রাহকদের আস্থা অর্জনে সফল হয়েছে। ফলে আমানতকারীরা আমাদের ওপর ভরসা রেখেছেন এবং আমরা সেই অর্থ সঠিকভাবে লাভজনক খাতে বিনিয়োগ করতে পেরেছি।”
আমানত ও ঋণে অভাবনীয় প্রবৃদ্ধি
২০২৪ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত ব্যাংকটির আমানতের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৫৮ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা এবং ঋণের পরিমাণ ছিল ৫৫ হাজার ৯৩৫ কোটি টাকা। এই দুই ক্ষেত্রেই ব্র্যাক ব্যাংক দেশের গড় প্রবৃদ্ধির তুলনায় অনেক এগিয়ে ছিল। ফলে ব্যাংকের নগদ প্রবাহও বেড়ে গেছে। বছরে শেষে শেয়ারপ্রতি নগদ অর্থের প্রবাহ দাঁড়িয়েছে ৬১ টাকা, যেখানে ২০২৩ সালে ছিল ৩৭ টাকা।
লভ্যাংশেও চমক
ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ ২০২৪ সালের জন্য রেকর্ড ২৫ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে ১২.৫ শতাংশ নগদ এবং ১২.৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার। সর্বশেষ ২০১৭ সালে এমন ২৫ শতাংশ লভ্যাংশ দেওয়া হয়েছিল, তবে সেটি ছিল সম্পূর্ণ বোনাস। ২০২৩ সালে মোট লভ্যাংশ ছিল ২০ শতাংশ। এই হিসাবে ২০২৪ সালের লভ্যাংশ ৫ শতাংশ বেশি।
লভ্যাংশের অংশ হিসেবে শেয়ারহোল্ডাররা প্রতি ১০০ শেয়ারের বিপরীতে ১২.৫টি নতুন শেয়ার পাবেন এবং নগদ লভ্যাংশ বাবদ ব্যাংকটি প্রায় ২২১ কোটি টাকা বিতরণ করবে।
ইপিএস ও এনএভি-তে বিশাল উন্নতি
২০২৪ সালের শেষে ব্র্যাক ব্যাংকের শেয়ারপ্রতি আয় (EPS) বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ টাকা ৯৫ পয়সা, যেখানে ২০২৩ সালে ছিল ৪ টাকা ৩০ পয়সা। এক বছরে EPS বেড়েছে ২ টাকা ৬৫ পয়সা বা প্রায় ৬২ শতাংশ। একই সঙ্গে শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য (NAV) বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৪ টাকা ১১ পয়সায়, যা আগের বছরে ছিল ৩৭ টাকা ৬০ পয়সা। এতে NAV বেড়েছে ৬ টাকা ৫১ পয়সা বা ১৭ শতাংশ।
বিনিয়োগকারীদের আস্থা এবং ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা
ব্র্যাক ব্যাংকের এই রেকর্ড মুনাফা ও শক্তিশালী আর্থিক ভিত্তি বিনিয়োগকারীদের মাঝে ব্যাপক আস্থা সৃষ্টি করেছে। দেশের শেয়ারবাজারে এমন মুনাফা ঘোষণার পর ব্যাংকটির শেয়ারের চাহিদাও বেড়ে গেছে। বাজার বিশ্লেষকদের মতে, ব্র্যাক ব্যাংক এখন দেশের অন্যতম বিনিয়োগযোগ্য ব্যাংকগুলোর একটি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, “যে সময়ে দেশের অনেক ব্যাংক কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ে আস্থার সংকটে ভুগছে, সেখানে ব্র্যাক ব্যাংকের এই পারফরম্যান্স পুরো খাতের জন্য একটি উদাহরণ।”
ব্যাংকিং খাতে দৃষ্টান্তমূলক অবস্থান
ব্র্যাক ব্যাংক শুরু থেকেই সুশাসন, প্রযুক্তিনির্ভর ব্যাংকিং এবং গ্রাহকসেবার মানোন্নয়নে গুরুত্ব দিয়েছে। তাদের ডিজিটাল ব্যাংকিং প্ল্যাটফর্ম, SME সাপোর্ট এবং নারী উদ্যোক্তা সহায়তা কার্যক্রম দেশের ব্যাংক খাতে এক অনন্য উদাহরণ হয়ে উঠেছে।
সারসংক্ষেপ
বিষয় | ২০২৩ | ২০২৪ | পরিবর্তন |
---|---|---|---|
একক মুনাফা | ৭৩০ কোটি টাকা | ১,২১৪ কোটি টাকা | +৬৬% |
সমন্বিত মুনাফা | ৮২৭ কোটি টাকা | ১,৪৩২ কোটি টাকা | +৭৩% |
EPS | ৪.৩০ টাকা | ৬.৯৫ টাকা | +৬২% |
NAV | ৩৭.৬০ টাকা | ৪৪.১১ টাকা | +১৭% |
লভ্যাংশ | ২০% | ২৫% | +৫% |
ক্যাশ ফ্লো প্রতি শেয়ার | ৩৭ টাকা | ৬১ টাকা | +৬৫% |
ব্র্যাক ব্যাংকের এই রেকর্ড মুনাফা শুধুমাত্র আর্থিক সাফল্য নয়, বরং দেশের ব্যাংক খাতে আস্থার প্রতীক। কঠিন সময়েও সুশাসন ও দূরদর্শী ব্যবস্থাপনায় প্রতিষ্ঠানটি প্রমাণ করেছে, সঠিক নেতৃত্ব, প্রযুক্তির ব্যবহার এবং গ্রাহকের আস্থাই সফল ব্যাংকিংয়ের মূল চাবিকাঠি।