অর্থনীতি

খাদ্য মূল্যস্ফীতির ‘লাল’ তালিকায় বাংলাদেশ: বিশ্বব্যাংকের নতুন প্রতিবেদন

বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে আবারও উঠে এসেছে বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগজনক একটি তথ্য। টানা প্রায় দুই বছর ধরে বাংলাদেশ রয়েছে খাদ্য মূল্যস্ফীতির ‘লাল’ তালিকায়। খাদ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে দেশের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের জীবনে নেমে এসেছে চরম ভোগান্তি। বিশ্বব্যাংকের ছয় মাস অন্তর প্রকাশিত এই খাদ্যনিরাপত্তা হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের অবস্থানে কোনও পরিবর্তন হয়নি।

লাল তালিকায় কেন বাংলাদেশ?

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যেসব দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশের মধ্যে রয়েছে, তাদের ‘লাল’ শ্রেণিতে রাখা হয়েছে। বাংলাদেশে প্রায় এক বছর ধরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপরে অবস্থান করছে।
বিশেষ করে ২০২৩ সালের মার্চের পর থেকে খাদ্যের দাম এতটাই বেড়েছে যে, টানা ১০ মাস ১০ শতাংশেরও বেশি খাদ্য মূল্যস্ফীতি দেখা গেছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এর তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে (২০২৪ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত) গড় খাদ্য মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৪৪ শতাংশ। অর্থাৎ, খাবার কেনার খরচ গড়ে প্রতি ১০০ টাকায় বেড়েছে ১০ টাকা ৪৪ পয়সা। এই পরিস্থিতি দীর্ঘ সময় ধরে স্থায়ী হয়ে থাকায় সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় মারাত্মক প্রভাব পড়েছে।

মূল্যস্ফীতি কিভাবে প্রভাব ফেলছে মানুষের ওপর

মূল্যস্ফীতি এক ধরনের অদৃশ্য করের মতো। সাধারণ মানুষের আয় যদি একই থাকে কিন্তু পণ্যের দাম বাড়ে, তাহলে তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যায়। ফলে অনেককে ধারদেনায় জড়াতে হচ্ছে অথবা দৈনন্দিন খরচ কমাতে বাধ্য হচ্ছেন।
বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ের প্রায় অর্ধেকই চলে যায় খাবার কেনায়। গরিব মানুষের ক্ষেত্রে এই হার আরও বেশি — প্রায় ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাবারের দাম যখন বাড়ে, তখন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষ। কারণ তাদের বাজেটে খাদ্যের জন্য বরাদ্দ সবচেয়ে বেশি, অন্য খাতের তুলনায়।

পরিস্থিতি মোকাবিলায় কী করা দরকার?

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেছেন, “বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এখন খাদ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা। এর জন্য শুধু মুদ্রানীতির উপর নির্ভর করলেই চলবে না, রাজস্বনীতি এবং বাজার ব্যবস্থাপনার দিকেও সমান গুরুত্ব দিতে হবে।”
তার মতে, বাজার তদারকি আরও জোরদার করা এবং সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রয়োজন।

বিশ্লেষকদের মতে, শুধু নীতিমালার ঘোষণা দিলেই হবে না; বাস্তবায়ন ও নিয়ন্ত্রণেও কঠোর হতে হবে। বিশেষ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারে সিন্ডিকেটের প্রভাব ভাঙা, আমদানি সহজীকরণ, এবং অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্যোগ জরুরি।

বিশ্বব্যাংকের শ্রেণিবিন্যাস: কোন দেশ কোথায়?

বিশ্বব্যাংক ১৭২টি দেশের খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার বিশ্লেষণ করে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করেছে:

  • বেগুনি শ্রেণি (মূল্যস্ফীতি ৩০% বা তার বেশি): সবচেয়ে সংকটাপন্ন দেশগুলো।
  • লাল শ্রেণি (মূল্যস্ফীতি ৫%-৩০%): উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ দেশ।
  • হলুদ শ্রেণি (মূল্যস্ফীতি ২%-৫%): মাঝারি ঝুঁকি।
  • সবুজ শ্রেণি (মূল্যস্ফীতি ২%-এর নিচে): স্থিতিশীল খাদ্য বাজার।

বাংলাদেশ ছাড়াও লাল শ্রেণিতে রয়েছে আরও ১৪টি দেশ — কঙ্গো, অ্যাঙ্গোলা, ইথিওপিয়া, গাম্বিয়া, গিনি, মাদাগাস্কার, ঘানা, ভারত, লাওস, লেসেথো, তিউনিসিয়া, জাম্বিয়া, বেলারুশ এবং রাশিয়া।

অন্যদিকে, সবচেয়ে খারাপ অবস্থা (বেগুনি শ্রেণি) দেখা যাচ্ছে ছয়টি দেশে — মালাওয়ি, দক্ষিণ সুদান, হাইতি, মিয়ানমার, আর্জেন্টিনা ও তুরস্ক।

সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে আটটি দেশ যারা সবুজ শ্রেণিতে রয়েছে। এই দেশগুলো হলো: সুইজারল্যান্ড, সুইডেন, সৌদি আরব, ম্যাকাও, চীন, ফ্রান্স, ফিনল্যান্ড ও বেনিন।

ভবিষ্যতের জন্য আশার আলো আছে কি?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাম্প্রতিক মাসগুলিতে বাংলাদেশের খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা কমেছে। ফেব্রুয়ারি এবং মার্চ মাসে তা এক অঙ্কের ঘরে নেমেছে, যা সামান্য স্বস্তির বিষয়। তবে এই ধারা বজায় রাখতে হলে নীতিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ অব্যাহত রাখতে হবে।

সরকার যদি বাজার তদারকি বাড়ায়, সরবরাহ ব্যবস্থা উন্নত করে, এবং কৃষকদের উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা দেয়, তাহলে আগামী দিনে খাদ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসতে পারে — এমনটাই আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন বিশ্লেষকেরা।

বাংলাদেশের জন্য খাদ্য মূল্যস্ফীতির সংকট শুধু একটি অর্থনৈতিক সমস্যা নয়, এটি সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্যও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তাই সময়োপযোগী এবং সমন্বিত উদ্যোগ এখন জরুরি। শুধু ঘোষণায় নয়, বাস্তবায়নেই এখন চাই দৃঢ়তা।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button