দেশে দ্বিতীয় কার্গো বিমানবন্দর চালু হচ্ছে আগামীকাল

ভারত কর্তৃক বাংলাদেশের ট্রানজিট সুবিধা স্থগিত করার পর রপ্তানি খাতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আজ রবিবার (২৭ এপ্রিল) সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে প্রথমবারের মতো কার্গো ফ্লাইট চালু হচ্ছে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে সিলেট বিমানবন্দর ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পর দেশের দ্বিতীয় কার্গো পরিচালনাকারী বিমানবন্দর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে। গ্যালিস্টেয়ার এভিয়েশনের একটি চার্টার্ড এয়ারবাস এ-৩৩০-৩০০ মালবাহী বিমান আজ সন্ধ্যায় ৬০ টন তৈরি পোশাক পণ্য নিয়ে স্পেনের উদ্দেশে যাত্রা করবে।
প্রস্তুতি ও উদ্বোধনী অনুষ্ঠান
বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মঞ্জুর কবির ভূঁইয়া শনিবার (২৬ এপ্রিল) বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থাকে (বাসস) জানান, প্রথম কার্গো ফ্লাইট চালুর জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। তিনি বলেন, “কার্গো চেক-ইন, নিরাপত্তা ব্যবস্থা, এবং গ্রাউন্ড-হ্যান্ডলিং সুবিধাসহ সকল প্রক্রিয়া প্রস্তুত। ফ্লাইটটি সন্ধ্যা ৭টা ১০ মিনিটে উড্ডয়নের কথা রয়েছে।”
এই ঐতিহাসিক ফ্লাইটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দিন। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন মেক্সিকোতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম. মুশফিকুল ফজল আনসারী এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব নাসরীন জাহান। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মালবাহী বিমানের সম্মানে জল কামান স্যালুট প্রদান করা হবে, যা এই মুহূর্তের গুরুত্বকে আরও উজ্জ্বল করবে।
স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সম্পৃক্ততা
বেবিচক চেয়ারম্যান জানান, সিলেটের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কে তাদের নিজস্ব পণ্য রপ্তানির জন্য উৎসাহিত করতে এই অনুষ্ঠানে তাদেরও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তিনি বলেন, “এই উদ্যোগ শুধু রপ্তানি সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য নয়, বরং স্থানীয় ব্যবসায়ীদের জন্য নতুন বাজারের সম্ভাবনা তৈরি করবে। বিশেষ করে ইউরোপে তৈরি পোশাকের বাজারে সিলেটের অবদান বাড়বে।” সিলেট অঞ্চলের প্রবাসী জনগোষ্ঠীর বড় অংশ ইউরোপ, আমেরিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যে বসবাস করে, যার ফলে এই অঞ্চলের পণ্যের চাহিদা, বিশেষ করে কাঁচা সবজি এবং তৈরি পোশাকের, উল্লেখযোগ্য।
কার্গো ফ্লাইটের তাৎপর্য
ভারতের ট্রানজিট সুবিধা বাতিলের ফলে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন। বাংলাদেশ ফ্রেট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, সাপ্তাহিক প্রায় ৬০০ টন বা মোট তৈরি পোশাক রপ্তানির ১৮ শতাংশ ভারতীয় বিমানবন্দর (কলকাতা ও দিল্লি) ব্যবহার করে পরিচালিত হতো। এই সুবিধা বাতিলের ফলে রপ্তানি ব্যয় বৃদ্ধি এবং সময় বিলম্বের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, “ভারতের বিমানবন্দর ব্যবহার করে রপ্তানি করলে পরিবহন ব্যয় কম হতো। গত ১৫ মাসে ৪৬ কোটি ডলারের পণ্য ভারতীয় বন্দর ব্যবহার করে রপ্তানি হয়েছে, যার ৫০ শতাংশ তৈরি পোশাক। সিলেট বিমানবন্দর থেকে কার্গো ফ্লাইট চালু হলে এই পরিমাণ পণ্য সরাসরি রপ্তানি করা সম্ভব হবে, যা ব্যয় ও সময় উভয় ক্ষেত্রেই সাশ্রয়ী হবে।”
বেবিচক এবং বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এই সংকট মোকাবেলায় দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছে। বিমান বাংলাদেশের কার্গো পরিচালক শাকিল মিরাজ বলেন, “আমরা ঢাকা থেকে সিলেটে গ্রাউন্ড-হ্যান্ডলিং সরঞ্জাম স্থানান্তর করেছি এবং ফ্লাইট পরিচালনার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত।” তিনি আরও জানান, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স বর্তমানে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ৭০০ জনের বেশি কর্মীর দলের পাশাপাশি অতিরিক্ত ৪০০ জন গ্রাউন্ড হ্যান্ডলার নিয়োগ করছে।
অবকাঠামো উন্নয়ন ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কার্গো ফ্লাইট চালুর জন্য ২৬ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি আধুনিক কার্গো কমপ্লেক্স ও টার্মিনাল নির্মাণ করা হয়েছে। বিমানবন্দরের পরিচালক হাফিজ উদ্দিন আহমদ জানান, “এই কার্গো টার্মিনাল অত্যন্ত ক্ষমতাসম্পন্ন এবং উল্লেখযোগ্য পরিমাণে পণ্য পরিচালনা করতে সক্ষম। নিরাপত্তা ব্যবস্থাসহ সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে।”
বেবিচক চেয়ারম্যান ভূঁইয়া জানান, শীঘ্রই চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকেও কার্গো ফ্লাইট চালু হবে, যা দেশের তৃতীয় কার্গো সুবিধাপ্রাপ্ত বিমানবন্দর হবে। তিনি বলেন, “আমরা কার্গো সংক্রান্ত চার্জ কমানোর জন্য একটি টাস্কফোর্স গঠনের পরিকল্পনা করছি। শিগগিরই কম টারিফ ঘোষণা করা হবে, যা ব্যবসায়ীদের জন্য আরও সাশ্রয়ী হবে।”
এদিকে, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের নির্মাণকাজ প্রায় শেষের দিকে। এই টার্মিনাল চালু হলে বাংলাদেশের কার্গো হ্যান্ডলিং সক্ষমতা বছরে ২ লাখ টন থেকে ৫ লাখ ৪৬ হাজার টনে উন্নীত হবে। নতুন টার্মিনালে ৩৬,০০০ বর্গমিটারের একটি বিশেষ কার্গো জোন থাকবে, যা স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা এবং বিস্তৃত সংরক্ষণ সুবিধা দ্বারা পরিচালিত হবে। ভূঁইয়া বলেন, “এই টার্মিনাল স্বাধীন এবং দক্ষ কার্গো পরিচালনা নিশ্চিত করবে, যা রাজস্ব বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।”
রপ্তানি খাতে প্রভাব
বর্তমানে বাংলাদেশ সাপ্তাহিক প্রায় ৩,৪০০ টন তৈরি পোশাক বিমানযোগে রপ্তানি করে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ দৈনিক ৩০০ টন ধারণক্ষমতার হলেও পিক সিজনে ১,২০০ টন পর্যন্ত পরিচালনা করে। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এই কার্গো ভলিউমের ১৬-১৭ শতাংশ পরিচালনা করে এবং এমিরেটস, ক্যাথে প্যাসিফিক, কাতার এয়ারওয়েজ, তুর্কিশ এয়ারলাইন্স এবং ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্সের মতো আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারদের জন্য গ্রাউন্ড-হ্যান্ডলিং সেবা প্রদান করে।
সিলেট ওসমানী বিমানবন্দর থেকে কার্গো ফ্লাইট চালু হওয়ায় রপ্তানিকারকদের ভোগান্তি কমবে এবং বাড়তি খরচ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। বেবিচক কর্মকর্তারা জানান, সিলেট ও চট্টগ্রাম বিমানবন্দর সম্প্রতি আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থা (আইকাও) কর্তৃক ক্যাটাগরি-১-এ উন্নীত হয়েছে, যা এই বিমানবন্দরগুলোর মাধ্যমে কার্গো ফ্লাইট পরিচালনার সক্ষমতাকে আরও শক্তিশালী করেছে।