অর্থনীতি

চালের বাজারে স্বস্তি নেই, দাম বাড়ার আভাসে নতুন শঙ্কা!

বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যপণ্য চালের বাজারে চলমান অস্থিরতা এখনও কমেনি। বরং বাজারে দামের ঊর্ধ্বগতি এবং সরকারিভাবে মূল্য বাড়ার আভাস নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে সাধারণ ভোক্তাদের মধ্যে। খাদ্য উপদেষ্টার সাম্প্রতিক বক্তব্য এবং বাজার পর্যবেক্ষকদের বিশ্লেষণে পরিষ্কার হয়ে উঠছে—চালের বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরে আসতে আরও সময় লাগতে পারে।

চালের বাজারে দ্বৈত বার্তা: উপদেষ্টাদের ভিন্নমত

গত ১৩ এপ্রিল বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন ঘোষণা করেছিলেন, আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে বোরো মৌসুমের নতুন ধান বাজারে আসবে, ফলে চালের দাম সহনীয় হয়ে উঠবে। এই ঘোষণায় সাধারণ মানুষ আশার আলো দেখেছিলেন। তবে ২৪ এপ্রিল খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার এক অনুষ্ঠানে জানিয়ে দেন, সরকার এবার কৃষকের স্বার্থে বিগত বছরের চেয়ে প্রতি কেজি ধানে চার টাকা বেশি মূল্য নির্ধারণ করেছে। যার ফলে বাজারে চালের দাম কিছুটা বাড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

এই দুই উপদেষ্টার বক্তব্যে তৈরি হয়েছে বিভ্রান্তি। ক্রেতাদের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে—বাজার আসলে কোন দিকে যাবে?

বর্তমান বাজারদর: বাড়তি ব্যয়ের চাপ

রাজধানীর বাজারগুলোতে বর্তমানে বিভিন্ন ধরণের চালের দাম নিম্নরূপ:

  • মিনিকেট চাল: ৮৬-৯০ টাকা/কেজি
  • আটাইশ চাল: ৬০-৬২ টাকা/কেজি
  • নাজিরশাইল চাল: ৭৬-৮৮ টাকা/কেজি
  • পোলাও চাল: ১১৬-১১৮ টাকা/কেজি

দামের এই ঊর্ধ্বগতি নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভোক্তাদের জন্য বাড়তি বোঝা হয়ে উঠেছে।

কৃষকের স্বার্থ বনাম ভোক্তার শঙ্কা

খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার বলেন, “কৃষক পরিশ্রম করে ধান ফলায়, যদি তাঁরা উপযুক্ত মূল্য না পান, তাহলে তারা ধান চাষে আগ্রহ হারাবেন।” এজন্য সরকারিভাবে ধান-চালের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। যদিও এই সিদ্ধান্ত কৃষকের পক্ষে ইতিবাচক, তবে বাজারে তার প্রভাব পড়ছে ভোক্তাদের ওপর।

বাজার বিশ্লেষক ও কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, “সরকারিভাবে দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিলেও তার আগেই ব্যবসায়ীরা মূল্য বাড়িয়ে দেন। তারা এই সুযোগে অতিমুনাফা করেন এবং বাজারে মনিটরিং না থাকায় কেউ তাদের প্রশ্ন করে না।”

ব্যবসায়ীদের মত: দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা নেই

চাল ব্যবসায়ীরা বলছেন, বোরো মৌসুমে নতুন ধান ওঠা শুরু হয়েছে। ফলে চালের দাম বাড়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। রাজধানীর কারওয়ান বাজারের বরিশাল রাইস এজেন্সির এক বিক্রেতা বলেন, “নতুন চাল এখনও বাজারে পুরোপুরি আসেনি, তবে আসলে দাম কমার সম্ভাবনা আছে।”

তবে মিল মালিকদের কারসাজির দিকেও ইঙ্গিত করেছেন ব্যবসায়ীরা। তাঁদের মতে, মিল পর্যায়ে সরকারি অভিযান চালালে বাজারে স্থিতি আসবে।

সিন্ডিকেট ও অতিমুনাফার অভিযোগ

বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার অভিযোগ নতুন নয়। নাসিম নামের এক ক্রেতা বলেন, “সরকার বলছে দাম বাড়বে, এতে ব্যবসায়ীরা সুযোগ নিচ্ছে। ভোক্তা হিসেবে আমরা পড়ছি বিপদে।” তিনি দাবি করেন, “সরকারের উচিত মজুতদার সিন্ডিকেট ভাঙা ও নিয়মিত বাজার মনিটরিং নিশ্চিত করা।”

বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের একেক বিভাগের ভিন্ন বার্তা এবং পর্যাপ্ত তদারকির অভাবেই চালের বাজারে অস্থিরতা থেকে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, চালের বাজারে স্বচ্ছতা এবং টেকসই মূল্যনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ছাড়া স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়।

সম্ভাব্য সমাধান ও করণীয়

নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো চালের বাজারে স্বস্তি ফেরাতে কার্যকর হতে পারে:

  1. মিল পর্যায়ে সরাসরি অভিযান: মিল মালিকদের মজুদ ও সরবরাহে কারসাজি ঠেকাতে নিয়মিত অভিযান দরকার।
  2. বাজার মনিটরিং টাস্কফোর্স: খাদ্য ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে বাজার পর্যবেক্ষণ ও মনিটরিং ইউনিট গঠন করতে হবে।
  3. সহজ তথ্যপ্রবাহ: সরকারিভাবে বাজারের প্রতিদিনের চাল ও ধানের দাম প্রকাশ করতে হবে যেন ব্যবসায়ী ও ভোক্তারা বিভ্রান্ত না হন।
  4. বিকল্প বাজার উন্নয়ন: ওএমএস ও টিসিবি’র মাধ্যমে সহজ মূল্যে চাল বিক্রির উদ্যোগ বাড়াতে হবে।

চালের বাজারে স্বস্তি ফেরাতে হলে সরকারের উচিত দ্ব্যর্থহীন ও সমন্বিত বার্তা দেওয়া, নিয়মিত বাজার তদারকি করা এবং মিল পর্যায়ে নজরদারি বাড়ানো। কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার পাশাপাশি ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। নীতিনির্ধারকদের এখন সবচেয়ে জরুরি কাজ হলো—বাজারে আস্থা ফিরিয়ে আনা।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button