অর্থনীতি

চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং টার্মিনাল সব আছে, তারপরও কেন বিদেশির হাতে যাচ্ছে

বাংলাদেশের সামুদ্রিক বাণিজ্যের প্রধান প্রবেশদ্বার চট্টগ্রাম বন্দরের সবচেয়ে বড় ও আধুনিক টার্মিনাল হলো নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি)। সর্বাধুনিক যন্ত্রপাতি, কার্যকর জনবল, এবং সফল দেশীয় পরিচালনার মাধ্যমে বিগত ১৭ বছর ধরে এই টার্মিনালটি হয়ে উঠেছে দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। অথচ এমন একটি লাভজনক ও সুসংগঠিত টার্মিনাল এখন বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যা নিয়ে তৈরি হয়েছে ব্যাপক আলোচনা, সমালোচনা ও উদ্বেগ।

টার্মিনালের সক্ষমতা ও বর্তমান অবস্থা

নিউমুরিং টার্মিনালটি ৯৫০ মিটার দীর্ঘ, যেখানে একসঙ্গে চারটি সমুদ্রগামী কনটেইনার জাহাজ এবং একটি অভ্যন্তরীণ ছোট জাহাজ নোঙর করতে পারে। টার্মিনালটিতে রয়েছে ১৪টি গ্যান্ট্রি ক্রেন, যেখানে দরকার ১২টি। এছাড়া কনটেইনার নামানোর পর পরিবহনের জন্য প্রয়োজনীয় সব আধুনিক যন্ত্রপাতিও রয়েছে। বার্ষিক গড় কনটেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতা ১০ লাখ ইউনিট হলেও গত বছর দেশীয় অপারেটর সেটি ছাড়িয়ে ১২.৮১ লাখ কনটেইনার হ্যান্ডল করেছে।

এই টার্মিনাল থেকে গত অর্থবছরে বন্দর কর্তৃপক্ষ আয় করেছে প্রায় ১,২১৬ কোটি টাকা। সব খরচ বাদ দিয়ে প্রকৃত আয় ছিল ৫৭৪ কোটি টাকা, অর্থাৎ প্রতি কনটেইনারে বন্দরের আয় ছিল গড়ে ৪৭ ডলার। এত লাভজনক এবং কার্যকর ব্যবস্থাপনার মধ্যেও কেন টার্মিনালটি বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত?

বিদেশি অপারেটরের হস্তান্তর পরিকল্পনা

আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ২০২৩ সালে প্রকল্পটি অনুমোদন পায়। এরপর ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশন (IFC) কে ট্রানজেকশন অ্যাডভাইজার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০২৫ সালের মে মাসে IFC একটি রিপোর্ট জমা দেবে, যার ভিত্তিতে আরএফপি পাঠিয়ে বছরের শেষ নাগাদ সংযুক্ত আরব আমিরাতের DP World-এর সঙ্গে কনসেশন চুক্তি স্বাক্ষরের পরিকল্পনা রয়েছে।

এই চুক্তি হলে DP World পুরো টার্মিনাল পরিচালনা করবে, লোকবল নিয়োগ ও মাশুল আদায় করবে। বন্দর পাবে এককালীন অর্থ, বার্ষিক ফি ও প্রতি কনটেইনারে নির্ধারিত অর্থ।

বিরোধের মূল কারণ: দক্ষতা বনাম স্বার্থরক্ষা

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, DP World-এর রয়েছে আন্তর্জাতিক মানের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা। তাদের উপস্থিতি বন্দরের প্রযুক্তিগত মান উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। অপরদিকে, বন্দরের একাধিক কর্মকর্তা ও শ্রমিক সংগঠন বলছে—এই টার্মিনালে নতুন করে তেমন কোনো বিনিয়োগের প্রয়োজন নেই। যন্ত্রপাতি ও অবকাঠামো সবই রয়েছে। দেশীয় প্রতিষ্ঠান তা সফলভাবে পরিচালনাও করছে।

বন্দরের সাবেক সদস্য মো. জাফর আলম বলেন, “নতুন অবকাঠামো তৈরিতে বিদেশি বিনিয়োগ যুক্তিযুক্ত, যেমন বে-টার্মিনাল ও লালদিয়ার চরে। কিন্তু নিউমুরিং টার্মিনালে সবকিছু প্রস্তুত। এখানে দেশীয় প্রতিষ্ঠানই যথেষ্ট।”

শ্রমিকদের উদ্বেগ ও আন্দোলন

টার্মিনাল পরিচালনায় বর্তমানে প্রায় ১,০০০ জন শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করছেন। শ্রমিকদের আশঙ্কা, বিদেশি প্রতিষ্ঠান এলে তাদের চাকরি হারানোর ঝুঁকি বাড়বে। বেতন কাঠামো ও সুবিধাও কমে যেতে পারে। যদিও নৌ উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন ও বন্দর চেয়ারম্যান এস এম মনিরুজ্জামান আশ্বাস দিয়েছেন—কারও চাকরি যাবে না, সেবার মান বাড়বে এবং বন্দর আর্থিকভাবে লাভবান হবে।

তবু শ্রমিক নেতা হুমায়ুন কবির বলেন, “দেশীয় অর্থে তৈরি অবকাঠামো বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া দেশের স্বার্থবিরোধী। বিদেশি বিনিয়োগ লাগলে তারা বে-টার্মিনালে আসুক, যেখানে এখনো কিছুই হয়নি।”

পতেঙ্গা টার্মিনালের উদাহরণ ও আশঙ্কা

চট্টগ্রাম বন্দরের পতেঙ্গা টার্মিনাল ইতোমধ্যে সৌদি আরবের Red Sea Gateway Terminal-এর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। সেখানে প্রতি কনটেইনারে বন্দর পায় ১৮ ডলার, যেখানে নিউমুরিংয়ে বর্তমান আয় প্রায় ৪৭ ডলার। যদি এই হারেই বিদেশিদের হাতে দেওয়া হয়, তাহলে বড় অঙ্কের আয় হারানোর আশঙ্কা রয়েছে।

সরকারের অবস্থান

সরকার বলছে, এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। দেশের স্বার্থকেই প্রাধান্য দেওয়া হবে। ব্যক্তিগত লাভ নয়, রাষ্ট্রীয় লাভ নিশ্চিত করতে হবে।

নৌ উপদেষ্টা বলেন, “যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, তা হবে দেশের স্বার্থে। এখানে কেউ ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হবে না।”

চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং টার্মিনাল কেবল একটি অবকাঠামো নয়; এটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতার প্রতীক। বিদেশি বিনিয়োগ অবশ্যই দরকার, তবে যেখানে প্রয়োজন সেখানেই হওয়া উচিত। সম্পূর্ণ প্রস্তুত, লাভজনক এবং দেশীয়ভাবে সফলভাবে পরিচালিত একটি টার্মিনাল বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টরা।

সরকারের উচিত হবে—আলোচনা, পর্যালোচনা এবং স্বচ্ছতা বজায় রেখে দেশের স্বার্থকে সর্বাগ্রে রেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া। নয়তো, কেবল লাভ নয়, হারানোর ভয়টাই বড় হয়ে উঠতে পারে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button