ঋণ সঞ্চিতি সময় বাড়ল, বাজারে ইতিবাচক সাড়া

বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে দীর্ঘদিনের একটি আলোচিত ইস্যু হচ্ছে ঋণাত্মক ঋণ হিসাব বা নেগেটিভ ইকুইটি সমস্যা। ২০১০ সালের শেয়ারবাজার ধসের পর এই সংকট সামনে আসে, যা আজও একাধিক ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে আছে। তবে সম্প্রতি বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা বাজার সংশ্লিষ্টদের মধ্যে সাময়িক স্বস্তি এনে দিয়েছে।
সময় বাড়ল নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণের
২০২৫ সালের ২৪ এপ্রিল, বৃহস্পতিবার বিএসইসির এক জরুরি সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যে, ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত ঋণাত্মক ঋণ হিসাবের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি (provisioning) সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ছাড় পাবে। তবে এ সুবিধা শর্তসাপেক্ষ, অর্থাৎ এটির জন্য নির্দিষ্ট পরিকল্পনা তৈরি এবং কমিশনে জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
এই সিদ্ধান্তের ফলে বাজারে হঠাৎ করে বড় আকারে শেয়ার বিক্রির চাপ কমবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কেননা, পূর্ণাঙ্গ প্রভিশনিং করতে গেলে অনেক প্রতিষ্ঠানকে লোকসানে থাকা শেয়ার বিক্রি করতে হতো, যা আবার বাজারে দরপতনের ঝুঁকি তৈরি করত।
কেন এ সিদ্ধান্ত গুরুত্বপূর্ণ?
বিএসইসির এই সময় বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত শুধু একটি প্রশাসনিক ঘোষণা নয়; এটি শেয়ারবাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার একটি কৌশলগত পদক্ষেপ। ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো ২০১০ সালের ধসের সময় উচ্চ দামে যেসব শেয়ার কিনে ঋণ দিয়েছিল, সেগুলোর বাজারমূল্য এখনো সেসময়ের তুলনায় অনেক কম। ফলে ঋণগ্রহীতা সেই ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না, আবার শেয়ার বিক্রি করেও সেই অর্থ উঠে আসছে না। এ অবস্থায় এই ঋণগুলো “ঋণাত্মক ঋণ হিসাব” বা “নেগেটিভ ইকুইটি” হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
২০১০ সালের পর থেকে এই হিসাবগুলো নিয়ে বিএসইসি একাধিকবার সময়সীমা বাড়িয়েছে। সর্বশেষ ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এ ধরনের সুবিধা ছিল। এরপর থেকে প্রতিষ্ঠানগুলোকে শতভাগ নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণের বাধ্যবাধকতা পড়ে যায়।
কাদের অনুরোধে এই সিদ্ধান্ত?
ডিএসই ব্রোকারস অ্যাসোসিয়েশন (ডিবিএ) এবং বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমবিএ) এই ইস্যুতে বারবার বিএসইসির কাছে সময় বৃদ্ধির দাবি জানিয়ে আসছিল। ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে, দেশের শীর্ষ ২০টি ব্রোকারেজ হাউসের প্রধান নির্বাহীরা বিএসইসির সঙ্গে একটি বৈঠকে বসেন। সেই বৈঠকেই তারা ২০৩০ সাল পর্যন্ত নিরাপত্তা সঞ্চিতিতে ছাড় চেয়ে প্রস্তাব দেন।
তবে বিএসইসি আপাতত ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত সময় বাড়িয়েছে, যাতে প্রতিষ্ঠানগুলো একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করে কমিশনের কাছে জমা দেয়।
পরিকল্পনা জমার সময়সীমা
যারা এই সুবিধা নিতে চান, তাদেরকে অবশ্যই ৩০ জুন ২০২৫-এর মধ্যে তাদের প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদিত একটি পরিকল্পনা বিএসইসির কাছে জমা দিতে হবে। পরিকল্পনাটিতে কীভাবে তারা ঋণাত্মক ঋণ হিসাবের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করবে, তার স্পষ্ট রূপরেখা থাকতে হবে।
বিএসইসি স্পষ্ট করে দিয়েছে, শুধুমাত্র সময় বাড়িয়ে দিলেই চলবে না—প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজ দায়িত্বে এ সমস্যার স্থায়ী সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে।
বাজারে সম্ভাব্য প্রভাব
নিরাপত্তা সঞ্চিতির বাধ্যবাধকতা শিথিল না করলে, ব্রোকারেজ হাউসগুলো হয়তো লোকসানে থাকা শেয়ার বিক্রি করে প্রভিশন তৈরি করতে বাধ্য হতো। এতে বাজারে নেতিবাচক সাইকোলজিক্যাল প্রভাব পড়তে পারত, কারণ হঠাৎ করে বড় পরিমাণ শেয়ার বিক্রির চাপ দরপতনের কারণ হতে পারে।
এখন যেহেতু সময় বাড়ানো হয়েছে, প্রতিষ্ঠানগুলোও চাপমুক্তভাবে পরিকল্পনা করতে পারবে এবং বাজারও কিছুটা স্থিতিশীল থাকবে।
ভবিষ্যতের দিক নির্দেশনা
বিএসইসি সূত্রে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানভেদে নির্ধারিত পরিকল্পনার ভিত্তিতে সময়সীমা আরও বাড়ানো হতে পারে। অর্থাৎ ৩১ ডিসেম্বরের পরও যেসব প্রতিষ্ঠান তাদের প্রস্তাবিত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যুক্তিসংগত অগ্রগতি দেখাতে পারবে, তারা অতিরিক্ত ছাড় পেতে পারে।
বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশা
বিনিয়োগকারীরা দীর্ঘদিন ধরেই বাজারে স্থিতিশীলতা কামনা করে আসছেন। তাদের অভিযোগ, ২০১০ সালের ধসের পর থেকে কোনো কার্যকর সংস্কার বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে প্রতিবার বাজার কিছুটা গতি পেলেই, পুরনো ঋণের বোঝা সামনে চলে আসে এবং নতুন সংকট তৈরি হয়।
এখন যেহেতু বিএসইসি একটি কার্যকর সময়সীমা নির্ধারণ করেছে এবং প্রতিষ্ঠানভিত্তিক সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে, তাই অনেকেই মনে করছেন, এবার হয়তো দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের দিকেই যাচ্ছে বিষয়টি।
ঋণাত্মক ঋণ হিসাব নিয়ে সমস্যা শুধু প্রতিষ্ঠানগুলোর নয়—এটি গোটা পুঁজিবাজারের জন্য একটি দীর্ঘদিনের ঘুণেধরা সমস্যা। এবার বিএসইসির সময়সীমা বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত একদিকে যেমন প্রতিষ্ঠানগুলোকে সুযোগ দিচ্ছে, অন্যদিকে দায়িত্বও চাপিয়ে দিচ্ছে।
যদি এই পরিকল্পনা যথাযথভাবে তৈরি ও বাস্তবায়ন হয়, তবে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ঝুলে থাকা এই সমস্যার একটা সমাধান মিলতে পারে। এর ফলে বাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা যেমন বাড়বে, তেমনি প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক ভারসাম্যও ফেরার সুযোগ তৈরি হবে।