ফলনের আগেই কৃষকের খাতায় শুধু লোকসান

মৌলভীবাজারের হাওরাঞ্চলে এবারের বোরো মৌসুম শুরুতেই কৃষকদের জন্য বয়ে এনেছে হতাশার সংবাদ। উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি পানির সংকট, সেচ সমস্যা ও রোগবালাইয়ে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে হাওরের ধানচাষ। অনেক জায়গায় ধানের ফলন অর্ধেকে নেমে এসেছে। ফলে বিনিয়োগের টাকা তুলতেই হিমশিম খাচ্ছেন কৃষকরা। মাঠে ধান থাকলেও খাতায় শুধু লোকসান।
ক্ষতির বৃত্তে আটকে কৃষক
মৌলভীবাজার সদর, রাজনগর ও কমলগঞ্জ উপজেলার হাওরাঞ্চল ঘুরে দেখা গেছে, কৃষকরা ধান কাটছেন ঠিকই, কিন্তু মুখে হাসি নেই। বরং চিন্তার ভাঁজ আরও গভীর।
রাজনগরের কাউয়াদীঘি হাওরের কৃষক সাইফুল ইসলাম বলেন,
“এক একর জমিতে খরচ হয়েছে ৩০-৩৫ হাজার টাকা, কিন্তু ধানের দাম পাচ্ছি ২০-২৫ হাজার টাকার বেশি না। সব টাকা ঋণ করে চাষ করেছিলাম। এখন সেই ঋণ কীভাবে শোধ করব, বুঝতে পারছি না।”
তাঁর মতো একই অবস্থা কমলগঞ্জের কৃষক আনোয়ার মিয়ারও। তিনি জানান,
“দুই একর জমিতে চাষ করেছি। কোথাও ফলন কিছুটা ভালো, কিন্তু বেশিরভাগ জায়গায় পানির অভাবে ফলন অর্ধেকে নেমে গেছে। এই ফলনে উৎপাদন খরচ ওঠে না।”
চাষাবাদে ভরসা ছিল ঋণেই, এখন সেটাই দায়
মাঠপর্যায়ের কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অধিকাংশ চাষিই এনজিও বা স্থানীয় মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে বোরো আবাদ করেছেন। কারও কারও জন্য এই ঋণ এখন ভয়ংকর বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কৃষকদের ভাষ্য অনুযায়ী, এবার বোরো চাষে খরচের ৩০% থেকে ৫০% পর্যন্ত লোকসান গুনতে হচ্ছে। অনেকে ধান বিক্রির টাকায় ঋণ শোধের আশায় ছিলেন, কিন্তু ফলন কমে যাওয়ায় সে আশাও ভেস্তে যাচ্ছে।
চাষ ব্যর্থ, সংকটে স্থানীয় অর্থনীতি
এই লোকসানের প্রভাব শুধু কৃষক পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নয়। মৌলভীবাজারের সামগ্রিক অর্থনীতি বিশেষ করে হাওর অঞ্চলের সাপ্লাই চেইন—মাঠের শ্রমিক, ধান মিলার, পরিবহনকর্মী, চাল ব্যবসায়ী সবাই ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।
একজন চালকল মালিক বলেন,
“আমরা আগেভাগেই কিছু ধান কিনি। কিন্তু এবার উৎপাদন এত কম যে কাঁচামাল জোগাড়ই করা যাচ্ছে না। যেটুকু পাওয়া যাচ্ছে, তা-ও মানসম্পন্ন নয়।”
ফলে বাজারে চালের সরবরাহ কমে গিয়ে দাম কিছুটা বাড়লেও, কৃষকরা আশানুরূপ মূল্য পাচ্ছেন না। চিটা ধানের পরিমাণ বেশি হওয়ায় বাজারে সেই ধানের চাহিদা কম, দামও কম। ফলে কৃষকের হাতে আসছে না কাঙ্ক্ষিত আয়।
সরকারি তথ্যে বাস্তব চিত্রের ফারাক
মৌলভীবাজার জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে জেলার ৬২ হাজার ১৪০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে, যার মধ্যে ৩৭ হাজার ৩১৫ হেক্টর হাওরাঞ্চলে। তবে অনেক এলাকায় উৎপাদন একরপ্রতি ২৫-৩০ মণ ধানে নেমে এসেছে, যেখানে স্বাভাবিকভাবে ৫০-৫৫ মণ হওয়ার কথা ছিল।
অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. জালাল উদ্দিন দাবি করেন,
“সব এলাকায় ব্যাপক ক্ষতি হয়নি। কিছু জায়গায় ফলন ভালো হয়েছে। পানির সংকট ও রোগবালাইয়ের কারণে কিছু নির্দিষ্ট এলাকাতেই সমস্যা দেখা দিয়েছে। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে ধান কাটার কাজ শেষ হবে।”
তবে মাঠের কৃষক ও মিলাররা বলছেন, বাস্তবতা ভিন্ন। কিছু এলাকায় ফলন মোটামুটি হলেও হাওরের বিস্তীর্ণ অংশেই ধান উঠছে অপ্রত্যাশিতভাবে কম।
চালের ঘাটতিতে সরবরাহ চেইনে ধাক্কা
হাওরাঞ্চল মৌলভীবাজারের ধানচাষকেন্দ্রিক মৌসুমি অর্থনীতির প্রধান ভিত্তি। ধান ঘিরেই কৃষি শ্রমিক থেকে শুরু করে খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প—সবকিছুর সরবরাহ চেইন গড়ে ওঠে। এবার সেই চেইনেই এসেছে বড় ধরনের ভাঙন।
চাল ব্যবসায়ী সমিতির এক সদস্য বলেন,
“এই হাওর এলাকা থেকে আমরা প্রতিবছর যে পরিমাণ ধান পাই, এবার তার অর্ধেকও মিলছে না। এতে মজুদ কমে যাচ্ছে, সরবরাহে টান পড়ছে।”
ফলন বিপর্যয়ের প্রভাব ইতিমধ্যে স্থানীয় বাজারে চালের দামে পড়তে শুরু করেছে। যদি দ্রুত সমাধান না হয়, তাহলে পরবর্তী কয়েক মাসে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ও বাজারে সরবরাহ ঘাটতির শঙ্কা রয়েছে।
কৃষকের দাবি: ঋণ পুনঃতফসিল ও ন্যায্যমূল্য
ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা চাইছেন, তাদের নেওয়া এনজিও বা ব্যাংক ঋণ যেন পুনঃতফসিল করা হয়। পাশাপাশি কৃষিপণ্যের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ন্যায্যমূল্যের নিশ্চয়তা ও সরাসরি ক্রয়ের ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি উঠছে।
কমলগঞ্জের এক কৃষক বলেন,
“আমরা চাই সরকার যেন মাঠ পর্যায় থেকে সরাসরি ধান কেনে। তাহলে কিছুটা হলেও লোকসান পুষিয়ে নিতে পারব।”
কৃষি ঝুঁকিতে, প্রয়োজন স্থায়ী সমাধান
হাওরের কৃষিপ্রধান অঞ্চলে প্রতিবছরই কোনো না কোনো কারণে ধানচাষ ঝুঁকির মুখে পড়ে। এবার যেমন পানির সংকট বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, আগামী বছর হয়তো বন্যা বা পোকামাকড়। এই অনিশ্চয়তা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে দরকার প্রযুক্তিনির্ভর চাষ পদ্ধতি, আগাম প্রস্তুতি এবং সরকারি সহায়তার পরিসর বাড়ানো।
বিশ্লেষকদের মতে, হাওরের অর্থনীতি যদি দীর্ঘমেয়াদে কার্যকর রাখতে হয়, তাহলে কৃষকের উৎপাদন ঝুঁকি কমাতে হবে এবং স্থানীয় অর্থনীতির ভিত্তি কৃষিপণ্যের ন্যায্য বাজার গড়ে তুলতে হবে।