ঝুঁকি বেড়ে গেছে বৈশ্বিক আর্থিক খাতের: আইএমএফ

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সম্প্রতি এক সতর্কবার্তায় জানিয়েছে, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অঙ্গনে নানা অনিশ্চয়তা ও রাজনৈতিক উত্তেজনার কারণে আর্থিক খাত বর্তমানে বড় ধরনের ঝুঁকির সম্মুখীন হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন পাল্টা শুল্কনীতির ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে, তা গোটা বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।
ওয়াশিংটনে ২১ এপ্রিল শুরু হওয়া বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ বসন্তকালীন বৈঠকে উপস্থাপিত ‘বৈশ্বিক আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন’-এ এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। সেখানে বলা হয়েছে, নীতিগত অনিশ্চয়তা এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রমের ধীরগতি মিলে বৈশ্বিক আর্থিক খাতকে এক জটিল বাস্তবতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আইএমএফের মতে, শেয়ার ও বন্ডসহ বেশ কিছু আর্থিক সম্পদের দাম সাম্প্রতিক সময়ে কমলেও, এখনো তা অতি মূল্যায়িত অবস্থায় রয়েছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে মূল্যহ্রাসের মাত্রা আরও গভীর হতে পারে।
ঋণভিত্তিক ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে
আইএমএফ বলছে, হেজ ফান্ড ও অন্যান্য বড় বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানগুলো অতিরিক্ত ঋণ গ্রহণ করেছে। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের আয়ের সঙ্গে যদি ব্যয়ের সামঞ্জস্য না থাকে, তাহলে তা গোটা আর্থিক ব্যবস্থাকে আরও ভঙ্গুর করে তুলতে পারে। ইতোমধ্যে বিশ্বের অনেক দেশের সরকার উচ্চ পরিমাণ ঋণ গ্রহণ করেছে এবং এই ঋণের সুদ গুণতে গিয়ে তাদের রাজস্বের বড় একটি অংশ চলে যাচ্ছে। যদি সুদের হার আরও বৃদ্ধি পায় কিংবা অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়ে, তাহলে ঋণ পরিশোধে সমস্যায় পড়তে পারে অনেক দেশ।
উদীয়মান বাজার অর্থনীতির দেশগুলো সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে রয়েছে। অতীতে উচ্চ নীতি সুদের কারণে এই দেশগুলোকে বেশি সুদে ঋণ নিতে হয়েছে। এখন বৈশ্বিক অর্থনীতিতে নতুন সংকট দেখা দিলে এই ঋণের বোঝা আরও বাড়বে। আইএমএফ বলছে, এসব দেশকে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর মাধ্যমে নিজেদের সক্ষমতা উন্নত করতে হবে।
বন্ড বাজারে অস্থিরতা
বড় বড় অর্থনীতির দেশগুলো আর্থিক ঘাটতি মেটাতে অধিক পরিমাণে সার্বভৌম বন্ড ছাড়ার পরিকল্পনা করছে। অথচ বর্তমানে বন্ড বাজার বেশ নাজুক অবস্থায় রয়েছে। বন্ডের চাহিদা কমে গেলে এসব দেশের বন্ডের সুদের হার বাড়বে এবং বাজারে অস্থিরতা আরও বৃদ্ধি পাবে। এর প্রভাব সরাসরি পড়বে উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর ওপর, যারা বৈদেশিক বাজার থেকে ঋণ সংগ্রহে নির্ভর করে।
আইএমএফ সতর্ক করে বলেছে, বিশ্বব্যাপী ঋণের সুদের হার বাড়লে এবং উদীয়মান দেশগুলোর আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল অবস্থায় থাকলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠবে। বিনিয়োগকারীরা তখন এসব দেশের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করতে পারেন, যা আস্থা সংকট সৃষ্টি করবে।
ব্যাংক খাতে সতর্কতা
ব্যাংকগুলোর ভূমিকা এই সংকট মোকাবিলায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আইএমএফের পরামর্শ, প্রতিটি দেশের সরকার যেন ব্যাংকগুলোর হাতে পর্যাপ্ত তারল্য নিশ্চিত করে। বিশেষ করে ব্যাসেল-৩ নীতিমালার পূর্ণ বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেছে সংস্থাটি। ২০০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের পর এই নীতিমালার প্রবর্তন করা হয়, যার লক্ষ্য ব্যাংক খাতকে স্থিতিশীল রাখা।
বেসরকারি ঋণ তহবিল: নতুন বিপদ
সম্প্রতি প্রাইভেট ক্রেডিট ফান্ড বা বেসরকারি ঋণ তহবিল থেকে ঋণ গ্রহণের প্রবণতা বেড়ে গেছে। অনেক কোম্পানি এসব তহবিল থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিচ্ছে। এই প্রক্রিয়ায় বড় বড় বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থ সরবরাহ করছে। তবে আইএমএফের আশঙ্কা, এই খাত সংকটে পড়লে তা অন্য খাতেও দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে, কারণ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক অত্যন্ত গভীর।
এই ‘ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি’ (contagion risk) বিশেষভাবে বিপজ্জনক, কারণ একটি খাত বা অঞ্চলে সৃষ্ট আর্থিক সংকট অন্য অঞ্চল বা খাতকে সহজেই আক্রান্ত করতে পারে। এতে শুধু একটি দেশ নয়, বরং গোটা অঞ্চলের অর্থনীতি দুর্বল হয়ে যেতে পারে।
ভূরাজনৈতিক ঝুঁকি ও আইএমএফের পরামর্শ
ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা এবং যুদ্ধের সম্ভাবনা বিশ্ব অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করছে। ইউক্রেন যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতা, চীন-তাইওয়ান ইস্যু এবং যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্যযুদ্ধ — এই সবকিছুর প্রভাব আর্থিক স্থিতিশীলতায় প্রতিফলিত হচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপটে আইএমএফের পরামর্শ, প্রতিটি দেশের আর্থিক তত্ত্বাবধানকারী সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভূরাজনৈতিক ঝুঁকি চিহ্নিত করতে হবে, তার মাত্রা নির্ধারণ করতে হবে এবং ব্যবস্থাপনার জন্য পর্যাপ্ত সম্পদ বরাদ্দ করতে হবে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল ও উদীয়মান দেশগুলোর উচিত তাদের আর্থিক বাজারকে আরও গভীর ও বহুমাত্রিক করা, যাতে বৈশ্বিক অভিঘাতে স্থিতিশীলতা রক্ষা করা যায়।
বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস
আইএমএফের সর্বশেষ পূর্বাভাস অনুসারে, বৈশ্বিক অর্থনীতির গড় প্রবৃদ্ধি ২০২৫ সালে ২ দশমিক ৮ শতাংশে সীমাবদ্ধ থাকবে। এটি আগের বছরের তুলনায় কম। এশিয়ার প্রবৃদ্ধি কিছুটা ভালো থাকলেও তা ৪ দশমিক ৫ শতাংশে থেমে যেতে পারে। প্রবৃদ্ধির এই হ্রাস অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা ও কর্মসংস্থানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
আইএমএফ-এর মতে, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হলে রাষ্ট্রগুলোকে রাজস্ব আদায়, আর্থিক খাতের সংস্কার এবং বহুজাতিক সহযোগিতা বাড়াতে হবে। এক দেশের সংকট যাতে অন্য দেশে ছড়িয়ে না পড়ে, সে জন্য যৌথভাবে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় এগিয়ে আসতে হবে।