অর্থনীতি

হুমকির মুখে দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ: বিশ্বব্যাংক

বিশ্বব্যাংক তাদের সর্বশেষ দ্বিবার্ষিক প্রতিবেদনে সতর্ক করে দিয়েছে যে, দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং আভ্যন্তরীণ কাঠামোগত দুর্বলতার কারণে এ অঞ্চলের প্রবৃদ্ধির গতি ক্রমশ কমছে। ‘দক্ষিণ এশিয়া ডেভেলপমেন্ট আপডেট: ট্যাক্সিং টাইমস’ শীর্ষক এই প্রতিবেদনে ২০২৫ সালের জন্য দক্ষিণ এশিয়ার সম্মিলিত প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৮ শতাংশে নামার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে, যা আগের পূর্বাভাসের তুলনায় ০ দশমিক ৪ শতাংশ কম।

বিশ্বব্যাংক জানায়, এই পতনের পেছনে অন্যতম কারণ হলো— দুর্বল রাজস্ব কাঠামো। যদিও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে করের হার তুলনামূলকভাবে বেশি, তবুও কর আদায়ের হার অনেক কম, যা সরকারের আর্থিক সক্ষমতা ও জনগণের জন্য সেবা নিশ্চিত করার ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করছে।

রাজস্ব ঘাটতির বাস্তব চিত্র

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০১৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ এশিয়ার গড় রাজস্ব আয় জিডিপির মাত্র ১৮ শতাংশ, যেখানে অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশে এটি ২৪ শতাংশ। এ অঞ্চলের কর্পোরেট আয়কর ও ব্যক্তিগত আয়কর ব্যবস্থাও ঘাটতিপূর্ণ। কর কাঠামোর মধ্যেই রাজস্ব আদায়ের ঘাটতি রয়েছে জিডিপির ১ থেকে ৭ শতাংশ পর্যন্ত। এর কারণ হিসেবে বিশ্বব্যাংকের বিশ্লেষকেরা দায়ী করেছেন:

  • অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির প্রভাব
  • কৃষি খাতের আকার
  • দুর্বল প্রশাসনিক কাঠামো
  • কর ফাঁকির সুযোগ

বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ফ্রাঞ্জিস্কা ওহনসোর্জ বলেন, “রাজস্ব ঘাটতি শুধু অর্থনৈতিক দুর্বলতার ইঙ্গিত নয়, বরং এটি দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলে। কর ব্যবস্থায় সংস্কার জরুরি না হলে সরকার সামাজিক সেবা দিতে ব্যর্থ হবে, যা দারিদ্র্য ও বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে তুলবে।”

দক্ষিণ এশিয়ার চ্যালেঞ্জ এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার

প্রতিবেদনে দক্ষিণ এশিয়ার জন্য পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ দেওয়া হয়েছে, যেগুলোর মাধ্যমে এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা সম্ভব হতে পারে:

  1. কর প্রশাসন শক্তিশালীকরণ: দক্ষ ও স্বচ্ছ প্রশাসন ছাড়া কর আদায় বাড়ানো সম্ভব নয়। কর কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ, ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহার এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
  2. কর আইন সরলীকরণ: বর্তমান কর আইন অনেক ক্ষেত্রেই জটিল ও বিভ্রান্তিকর। সহজ ও স্পষ্ট নিয়ম প্রণয়ন করলে করদাতারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে কর দিতে উৎসাহী হবেন।
  3. কর ফাঁকি প্রতিরোধ: কর ফাঁকি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বড় সমস্যা। কার্যকর তদারকি এবং কঠোর শাস্তির বিধান থাকলে কর ফাঁকি হ্রাস সম্ভব।
  4. ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার: কর নীতিতে প্রযুক্তি সংযোজন রাজস্ব আদায়ে সহায়ক হতে পারে। অনলাইন ফাইলিং, অটোমেটেড হিসাব ব্যবস্থা এবং ডিজিটাল রেকর্ড ব্যবস্থার প্রসার প্রয়োজন।
  5. পরিবেশ-ভিত্তিক করনীতি: জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে টেকসই অর্থনীতির জন্য পরিবেশবান্ধব করনীতি যেমন— কার্বন ট্যাক্স ও সবুজ কর প্রয়োগ করা যেতে পারে।

অর্থনীতিতে কৃষির ভূমিকা ও জলবায়ু ঝুঁকি

বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক মার্টিন রেইজার জানান, “গত এক দশকে দক্ষিণ এশিয়া একাধিক অপ্রত্যাশিত চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে গেছে— যেমন কোভিড-১৯ মহামারি, ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ ইত্যাদি। এসব ঘটনায় আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে কৃষি, যা এখনও এ অঞ্চলের মানুষের জীবিকার মূল উৎস।”

কৃষি উৎপাদনে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ইতিমধ্যেই দেখা যাচ্ছে। খরার প্রকোপ, অপ্রত্যাশিত বৃষ্টিপাত, ভূমিক্ষয় ও উষ্ণায়নের কারণে ফসল উৎপাদন কমে যাচ্ছে, যা খাদ্য নিরাপত্তাকেও হুমকির মুখে ফেলেছে। তাই বিশ্বব্যাংক কৃষি খাতকে আধুনিকায়ন ও জলবায়ু সহনশীল করার পরামর্শ দিয়েছে।

বৈষম্য ও দারিদ্র্যের বাস্তবতা

দক্ষিণ এশিয়ার বেশিরভাগ দেশেই আয়ের বৈষম্য এবং দারিদ্র্য এখনো উচ্চমাত্রায় রয়ে গেছে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর অর্থনৈতিক চাপ বেশি পড়ে, যখন রাজস্ব ঘাটতির কারণে সরকার শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তার মতো খাতে পর্যাপ্ত ব্যয় করতে পারে না। ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হলেও তা সবাইকে ছুঁতে পারে না।

বিশ্বব্যাংকের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি করলে তা দীর্ঘমেয়াদে দারিদ্র্য হ্রাস এবং সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে।

ভবিষ্যতের জন্য কী করণীয়?

বিশ্বব্যাংক বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো যদি রাজস্ব সংগ্রহে সক্ষমতা বাড়াতে পারে এবং টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতি গঠনের দিকে এগিয়ে যায়, তাহলে এই অঞ্চল আগামী দশকে বিশ্ব অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি হয়ে উঠতে পারে। তবে তার জন্য দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক দক্ষতা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা।

এছাড়া, প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষতা অর্জন, শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নে বিনিয়োগ, এবং লিঙ্গ সমতা ও অন্তর্ভুক্তি বৃদ্ধিও এই অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য।

উপসংহার

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনের ভাষ্যে যে চিত্র ফুটে উঠেছে, তা শুধু সতর্কবার্তা নয়, বরং পরিবর্তনের আহ্বান। দক্ষিণ এশিয়া যদি সময়মতো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে না পারে, তাহলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা ব্যাহত হবে এবং লাখ লাখ মানুষের জীবনে অনিশ্চয়তা দেখা দেবে। এই বাস্তবতায় কর সংস্কার ও রাজস্ব ব্যবস্থায় পরিবর্তন এখন সময়ের দাবি।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button