রপ্তানি মাশুল বাড়ানোর সিদ্ধান্ত: পাট শিল্পের ওপর প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া

বাংলাদেশের পাট শিল্পের জন্য সরকারের নতুন সিদ্ধান্ত একটি বড় পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। দীর্ঘ ৩০ বছর পর কাঁচা পাট এবং পাটজাত পণ্যের রপ্তানি মাশুল (ফি) বাড়ানো হয়েছে। সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে, কাঁচা পাটের প্রতি বেল রপ্তানিতে ৭ টাকা রাজস্ব মাশুল নির্ধারণ করা হয়েছে, যা পূর্বে ছিল মাত্র ২ টাকা। অর্থাৎ, এই মাশুল বেড়ে হয়েছে প্রায় সাড়ে তিন গুণ। এছাড়া, পাটজাত পণ্যের প্রতি ১০০ টাকা রপ্তানি মূল্যে রাজস্ব মাশুল বেড়ে ৫০ পয়সা হয়ে গেছে, যা আগে ছিল ১০ পয়সা।
বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় গত ২০ এপ্রিল এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে, যা দেশের পাট শিল্পের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। এই প্রজ্ঞাপনটি ১৯৯৫ সালের ১ জুলাই জারি হওয়া পূর্ববর্তী প্রজ্ঞাপনের পরিবর্তে এসেছে। তবে, নতুন এই সিদ্ধান্তে পাট শিল্পের সাথে জড়িত বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে, বিশেষ করে রপ্তানিকারকদের মধ্যে।
নগদ সহায়তার কমানো ও মাশুল বৃদ্ধির নীতি
২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম দিন থেকে পাট শিল্পে নগদ সহায়তা কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। তখন পাটজাত পণ্যের রপ্তানিতে নগদ সহায়তা ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ এবং পাট সুতায় ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছিল। কিন্তু, রপ্তানি মাশুল বৃদ্ধির সিদ্ধান্তের পর, এই পরিবর্তন আরও জোরালোভাবে শিল্পের ওপর প্রভাব ফেলবে।
বিজেএসএ (বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশন) এর সভাপতি তাপস প্রামাণিক প্রথম আলোকে বলেন, “পাটকে অন্যান্য খাতের সঙ্গে তুলনা করা যাবে না। এখানে কৃষকের পাশাপাশি শ্রমিকদের স্বার্থও জড়িত। পলিপ্রপাইলিনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে আমাদের প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হচ্ছে। সরকার এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাদের হতাশ করেছে। আমরা চাই, এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা হোক।”
সরকারী রাজস্ব বৃদ্ধির উদ্দেশ্য
অর্থ মন্ত্রণালয় বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি পাঠিয়ে রাজস্ব বাড়ানোর জন্য প্রস্তাবনা দিয়েছিল। সেই অনুযায়ী, পাট অধিদপ্তর বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব দেয় যে, কাঁচা পাটের প্রতি বেল এবং পাটজাত পণ্যের প্রতি ১০০ টাকার রপ্তানি মূল্যে রাজস্ব মাশুল বাড়ানো হোক। সরকারের এই সিদ্ধান্তের উদ্দেশ্য রাজস্ব আয় বৃদ্ধি করা, তবে এতে ব্যবসায়ী ও রপ্তানিকারকরা শঙ্কিত।
রপ্তানির ক্ষেত্রে অবনতির চিত্র
পাট শিল্পের জন্য সরকারের নতুন সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে, এই খাতে পাট অধিদপ্তরের আয় বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। পাট অধিদপ্তর জানায়, রপ্তানির মাধ্যমে রাজস্ব আদায় বাড়বে, যা বর্তমানে তিন কোটি টাকার মতো থাকে, তবে তা নতুন নিয়ম অনুযায়ী প্রায় ১৫ কোটি টাকা হতে পারে। রপ্তানির সময়, ব্যাংকগুলোই উৎসে মাশুল কেটে রেখে পাট অধিদপ্তরে জমা দেবে।
তবে, বাস্তবে পাট শিল্পের পরিস্থিতি খুব ভালো নয়। ভারতের বাজারে বাংলাদেশি পাটের সুতা রপ্তানি কমে গিয়ে ৫ ভাগের ১ ভাগে নেমে গেছে। এর প্রধান কারণ, ভারত পাটপণ্যের ওপর অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক আরোপ করেছে। এর ফলে, বাংলাদেশের পাটপণ্যের বাজারও সংকুচিত হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের পাটজাত পণ্যের রপ্তানি আয় ছিল ১১২ কোটি ৭৬ লাখ ডলার, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরে কমে ৯১ কোটি ১৫ লাখ ডলারে নেমে আসে। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে, এটি আরও কমে ৮৫ কোটি ৫২ লাখ ডলারে দাঁড়িয়েছে।
পাট উৎপাদন এবং রপ্তানি পরিস্থিতি
বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৭৫ থেকে ৮০ লাখ বেল কাঁচা পাট উৎপাদিত হয়, যার মধ্যে ৬০ লাখ বেল ব্যবহৃত হয় পাটজাত পণ্য উৎপাদনের জন্য। পাট অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১৩ লাখ ৪৪ হাজার ৮৩৫ বেল কাঁচা পাট রপ্তানি হয়েছে, যার মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, চীনসহ ১৩টি দেশে রপ্তানি হয়েছে। এই রপ্তানি থেকে মোট আয় হয়েছে ১৬ কোটি ৪ লাখ ৮৭ হাজার মার্কিন ডলার, যার মধ্যে ৯ কোটি ডলারের বেশি এসেছে ভারত থেকে।
চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ দিশা
বাংলাদেশের পাট শিল্প এখন সংকটের মধ্যে রয়েছে। পলিপ্রপাইলিন এবং অন্যান্য সিনথেটিক পণ্য বাজারে প্রবেশ করায় পাটের চাহিদা হ্রাস পাচ্ছে। এর সাথে যোগ হয়েছে সরকারের নতুন মাশুল বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত, যা পাট রপ্তানিকারকদের জন্য আরও চাপ সৃষ্টি করবে। তবে, শিল্পটি যদি বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ লাভ করতে চায়, তবে প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনী প্রচেষ্টা প্রয়োজন, পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারের প্রতি মনোযোগী হতে হবে।
আসলে, পাট শিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, বিশেষ করে কৃষকদের জীবিকায়। তাই, সরকারের এই নতুন সিদ্ধান্তে পাট শিল্পের ভবিষ্যৎ কী হতে পারে, তা এখন সময়ই বলে দেবে।