এপ্রিলের ২১ দিনে প্রায় দুই বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স

চলতি এপ্রিল মাসের প্রথম ২১ দিনে দেশের প্রবাসী আয় প্রায় দুই বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি পৌঁছেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুসারে, ২১ এপ্রিল পর্যন্ত ১৯৬ কোটি ৬০ লাখ মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স দেশে এসেছে। প্রতি ডলার ১২২ টাকা হিসেবে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ২৩ হাজার ৯৮৫ কোটি ২০ লাখ টাকা, যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ক্ষেত্রে এক বিশাল সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
প্রতিদিন গড়ে ৯ কোটি ৩৬ লাখ ডলার বা প্রায় ১১৪২ কোটি টাকারও বেশি রেমিট্যান্স দেশে আসছে। এই গড় প্রবাহ দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে স্বস্তি ফিরিয়ে আনছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
গত বছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধি প্রায় ৪১ শতাংশ
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছরের এপ্রিল মাসের প্রথম ২১ দিনে দেশে এসেছিল ১৩৯ কোটি ৭০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স। সে হিসেবে চলতি বছর একই সময়ে রেমিট্যান্স বেড়েছে ৫৬ কোটি ৯০ লাখ ডলার। শতকরা হিসাবে এই প্রবৃদ্ধি প্রায় ৪১ শতাংশ, যা গত কয়েক বছরের তুলনায় একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, রেমিট্যান্সের এই উল্লম্ফন মূলত বৈধ চ্যানেলে অর্থ প্রেরণে সরকারের নানা উদ্যোগ, হুন্ডি প্রতিরোধে কড়াকড়ি, ও প্রবাসীদের জন্য ব্যাংকিং সেবা সহজীকরণের ফল। এছাড়া, বৈধ পথে প্রেরণকারীদের জন্য নগদ প্রণোদনার হার বাড়ানো এবং ডিজিটাল রেমিট্যান্স প্ল্যাটফর্মের প্রসারও এই বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।
মার্চ মাসেও ছিল রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স
চলতি বছরের মার্চ মাসেও দেশে রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স এসেছে। মার্চ মাসে দেশে এসেছে ৩২৯ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৪০ হাজার ১৩৮ কোটি টাকার সমপরিমাণ। গড়ে প্রতিদিন এসেছে প্রায় ১০.৬১ কোটি ডলার বা ১২৯৫ কোটি টাকা। মার্চ মাসে রেমিট্যান্স প্রবাহের এই ঊর্ধ্বগতি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও মুদ্রানীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, “সম্প্রতি সময়কালে রেমিট্যান্সে যে ইতিবাচক ধারা দেখা যাচ্ছে তা ধরে রাখতে আমরা ব্যাংকগুলোকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছি। পাশাপাশি মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মকে আরও শক্তিশালী করা হচ্ছে।”
২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৯ মাস ২১ দিনে রেমিট্যান্সে উল্লম্ফন
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ৯ মাস ২১ দিনে (জুলাই থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত) দেশে মোট ২ হাজার ৩৭৫ কোটি ১০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। প্রতি ডলার ১২২ টাকা হিসেবে এর টাকার পরিমাণ প্রায় ২ লাখ ৮৯ হাজার ৭৭১ কোটি টাকা।
অন্যদিকে, গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে দেশে এসেছিল ১ হাজার ৮৪৭ কোটি ১০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স। অর্থাৎ, চলতি অর্থবছরে রেমিট্যান্স বেড়েছে ৫২৮ কোটি ডলার, যা শতকরা হিসাবে প্রায় ২৯ শতাংশ বেশি।
অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকিং বিশেষজ্ঞদের মতে, এই প্রবৃদ্ধি অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়ক হবে। ডলারের দাম নিয়ে সাম্প্রতিক উদ্বেগের প্রেক্ষাপটে এই রেমিট্যান্স প্রবাহ দেশীয় মুদ্রার ওপর চাপ কমাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
চ্যালেঞ্জ ও করণীয়
যদিও রেমিট্যান্স প্রবাহে ইতিবাচক ধারা লক্ষ করা যাচ্ছে, তবুও সামনে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন অঞ্চলে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, শ্রমবাজারে সংকোচন এবং অভিবাসী শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে নতুন কিছু বিধিনিষেধ ভবিষ্যতে রেমিট্যান্স প্রবাহে প্রভাব ফেলতে পারে।
তাই রেমিট্যান্স প্রবাহ ধরে রাখতে হলে সরকারকে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন—
- নতুন শ্রমবাজার খোঁজা ও চুক্তিভিত্তিক অভিবাসন বৃদ্ধি।
- বিদেশে অবৈধভাবে অবস্থানরত প্রবাসীদের বৈধতা প্রদান ও ব্যাংকিং সুবিধা নিশ্চিত করা।
- হুন্ডি প্রতিরোধে কঠোর নজরদারি ও আইনি পদক্ষেপ।
- বৈধ পথে অর্থ প্রেরণে আরও আকর্ষণীয় প্রণোদনা ঘোষণা।
উপসংহার
রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি অন্যতম প্রধান চালিকা শক্তি। এ বছরের এপ্রিল মাসের প্রথম ২১ দিনে প্রায় দুই বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স প্রবাহ ইতিবাচক বার্তা বহন করছে। বৈধ পথে প্রেরণ বৃদ্ধির কারণে সরকারের আর্থিক নীতিতে স্বস্তি আসছে, যা সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় একটি স্থিতিশীল পরিবেশ তৈরিতে সহায়ক হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধারা বজায় রাখতে হলে প্রবাসীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ, প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার এবং প্রশাসনিক সহায়তা অব্যাহত রাখতে হবে। কারণ প্রবাসী আয়ের এই ধারাবাহিকতা শুধু রিজার্ভ বৃদ্ধিই নয়, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামগ্রিক স্থিতিশীলতার অন্যতম ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।