পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি: কৃষক ও ব্যবসায়ীদের মতামত

ঢাকা শহরের বিভিন্ন বাজারে সম্প্রতি পেঁয়াজের দাম হঠাৎ করে বেড়েছে। একদিকে পেঁয়াজের বাজার চড়া, অন্যদিকে বাড়তি দাম নিয়ে ব্যবসায়ী, কৃষক এবং মজুতদারদের মধ্যে নানা মত রয়েছে। ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে কৃষক পর্যন্ত সবাই বলছেন, পেঁয়াজের দাম বাড়ার পেছনে কিছু বিশেষ কারণ রয়েছে।
দুই সপ্তাহের ব্যবধানে ৩০ শতাংশ দাম বৃদ্ধি
রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ দুই সপ্তাহ আগে তিন কেজি পেঁয়াজ কিনেছিলেন। তখন তিনি প্রতিকেজি ৫০ টাকায় পেঁয়াজ কিনেছিলেন, কিন্তু আজ আবার সেই একই বাজার থেকে পেঁয়াজ কিনে কেজিপ্রতি ৬৫ টাকা দিতে হয়েছে। অর্থাৎ, কেজিপ্রতি ১৫ টাকার বৃদ্ধি, যা প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়েছে।
মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ প্রথম আলোকে জানান, পেঁয়াজের দাম হঠাৎ বেড়েছে। একদিকে সয়াবিন তেলের দাম বাড়ছে, অন্যদিকে চাল, সবজি এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দামও আগে থেকেই চড়া ছিল। এখন পেঁয়াজের দামও বৃদ্ধি পেয়েছে।
উৎপাদন কম, মজুতকারীদের কারসাজি
পেঁয়াজের দাম বাড়ার মূল কারণ হিসেবে কৃষক, ব্যবসায়ী এবং আড়তদাররা প্রায় একমত হয়েছেন। তাদের মতে, জমিতে এখন পেঁয়াজের কোনো ফসল নেই। কৃষকরা পেঁয়াজ ঘরে তুলেছেন এবং অধিকাংশ পেঁয়াজ মজুতকারীরা কিনে রাখছেন। মজুতকারীরা দাম আরও বাড়বে বলে আশা করছেন এবং এজন্য বাজারে কম পরিমাণে পেঁয়াজ বিক্রি করছেন।
এছাড়া, পেঁয়াজের মৌসুম শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে বাজারে সরবরাহ কমে গেছে। ফলে দাম বেড়েছে। বর্তমানে রাজধানীর শেওড়াপাড়া, মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট এবং টাউন হল বাজারের দাম কেজিপ্রতি ৫৫ থেকে ৬৫ টাকা। কিছু পাড়ার বাজারে দাম ৫ থেকে ১০ টাকা বাড়তি। এসব পেঁয়াজ ফরিদপুর ও মানিকগঞ্জ এলাকার উৎপাদিত। তবে পাবনা অঞ্চলের পেঁয়াজের দাম আরও বেশি, যেখানে কেজি প্রতি দাম ৭০ টাকার কাছাকাছি।
টিসিবি’র তথ্যেও দাম বৃদ্ধি
টিসিবি (ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ) এর সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানেও পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে। গত সপ্তাহে খুচরা বাজারে পেঁয়াজের দাম ছিল ৩০ থেকে ৫০ টাকা, কিন্তু চলতি সপ্তাহে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০ থেকে ৬৫ টাকায়। এটি প্রায় ১০ থেকে ১৫ টাকার বৃদ্ধি। গত বছর একই সময়ে পেঁয়াজের দাম ছিল ৬০ থেকে ৬৫ টাকা।
উৎপাদনস্থলে বেড়েছে দাম
ঢাকা শহরের কারওয়ান বাজারের পাইকারি পেঁয়াজ বিক্রেতা মো. সেলিম মল্লিক জানান, উৎপাদনস্থল থেকেই পেঁয়াজের দাম বেড়ে গেছে। কৃষক ও আড়তদারের কাছ থেকে বেশি দামে পেঁয়াজ কিনতে হচ্ছে, যার কারণে ঢাকার বাজারেও দাম বেড়েছে।
উৎপাদনস্থলের বর্তমান পরিস্থিতি
পেঁয়াজের অন্যতম বড় উৎপাদনস্থান পাবনার সাঁথিয়া উপজেলা। এখানকার পেঁয়াজের দাম গত সপ্তাহে প্রতি মণ ২,০০০ থেকে ২,২০০ টাকা ছিল, যা কেজি ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। অথচ সপ্তাহ দুই আগে এই দাম ছিল মণপ্রতি ১,২০০ থেকে ১,৫০০ টাকা (কেজি ৩০ থেকে ৩৮ টাকা)। সুতরাং, গত দুই সপ্তাহে প্রতি মণ পেঁয়াজের দাম ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা বেড়েছে।
ফরিদপুরের ময়েনদিয়া বাজারে গত ১৫ দিনের মধ্যে মণপ্রতি পেঁয়াজের দাম বেড়েছে প্রায় ৫০০ টাকা। সেখানে বর্তমানে প্রতি মণ পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১,৮৫০ থেকে ১,৯০০ টাকায় (কেজি ৪৬ থেকে ৪৮ টাকা)। মানিকগঞ্জে গত শনিবার পেঁয়াজের দাম ছিল প্রতি কেজি ৫০ টাকা।
দাম বাড়ানোর কারণ
পাবনার সাঁথিয়া উপজেলা এবং ফরিদপুরের খোয়ার গ্রামের পেঁয়াজচাষি এবং আড়তদাররা জানান, ১৫ থেকে ২০ দিন আগে কৃষকের জমি থেকে সরাসরি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছিল। কিন্তু এখন জমিতে কোনো পেঁয়াজ নেই এবং সব পেঁয়াজ কৃষকের ঘরে রাখা হয়েছে। অধিকাংশ পেঁয়াজ কৃষকরা সংরক্ষণের জন্য মজুত করেছেন।
এছাড়া, কৃষকরা এবার চাষের খরচের জন্য পেঁয়াজ তোলার মৌসুমে অনেক পেঁয়াজ বাজারে এনেছিলেন। কিন্তু এখন বাছাই করা পেঁয়াজ কৃষকের কাছে রয়েছে, যা দীর্ঘ সময় সংরক্ষণযোগ্য। এ কারণে তারা দাম বেড়ে যাওয়ার পর বাজারে পেঁয়াজ বিক্রি করছেন।
এ বছরের পেঁয়াজের উৎপাদন খরচও বেড়েছে। যেমন ফরিদপুরের মাফিকুল ইসলাম জানান, অনাবৃষ্টির কারণে তাকে তিন দফা সেচ দিতে হয়েছে, ফলে উৎপাদন খরচ বেড়েছে। তবে বর্তমানে দাম বেড়ে যাওয়ায় তিনি ক্ষতি কমাতে পেরেছেন।
কৃষকদের সুরক্ষা
কৃষকদের জন্য পেঁয়াজের দাম বাড়ানো একটি আশাব্যঞ্জক বিষয়, কারণ এটি তাদের লোকসান থেকে রক্ষা করেছে। ফরিদপুরের সালথা উপজেলার পেঁয়াজচাষি মাফিকুল ইসলাম জানান, এই বছর তারা মুড়িকাটা পেঁয়াজের দাম পাননি। তবে, বর্তমানে দাম বাড়ায় তারা কিছুটা লাভ করতে পেরেছেন।
ফরিদপুর জেলার জ্যেষ্ঠ কৃষি বিপণন কর্মকর্তা সাহাদাত হোসেন জানান, বর্তমানে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে এবং ব্যবসায়ী ও কৃষকরা দাম বাড়ানোর আশায় পেঁয়াজ সংরক্ষণ করছেন। এর ফলে বাজারে পেঁয়াজের সরবরাহ কমে গেছে এবং দাম বৃদ্ধি পেয়েছে।
পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জন্য নতুন চাপ সৃষ্টি করেছে, তবে কৃষকরা এই পরিস্থিতিতে লাভবান হতে পারছেন। সরকারি সংস্থা এবং বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে, যার মধ্যে মজুতদারদের কারসাজি, উৎপাদন কম হওয়া এবং আমদানি কম হওয়া অন্যতম।
এই পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে, তবে সরকারের উচিত বিষয়টি মনিটর করা এবং বাজারে সঠিক ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করা। কেননা, এই ধরনের মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।