অর্থনীতি

চীনা পণ্যে শুল্ক বাড়িয়ে ২৪৫ শতাংশ করলো যুক্তরাষ্ট্র

বিশ্ব অর্থনীতির দুই প্রধান শক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য উত্তেজনা আরও এক ধাপ বাড়লো। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন চীনা পণ্যের ওপর শুল্কের হার বাড়িয়ে ২৪৫ শতাংশে উন্নীত করার ঘোষণা দিয়েছে। হোয়াইট হাউসের এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, বেইজিংয়ের পাল্টা শুল্কারোপের জবাবে যুক্তরাষ্ট্র এই কঠোর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছে। এই পদক্ষেপকে ‘আমেরিকা ফার্স্ট ট্রেড পলিসি’-র অংশ বলেও উল্লেখ করেছে মার্কিন প্রশাসন।

বাণিজ্য উত্তেজনার শুরু

চলতি বছরের এপ্রিলের শুরু থেকেই দুই দেশের মধ্যে এই শুল্ক যুদ্ধ নতুন মাত্রা পায়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার ‘প্রোটেকশনিস্ট’ নীতির আওতায় বিদেশি পণ্যের ওপর উচ্চ শুল্ক আরোপের মাধ্যমে দেশের শিল্প এবং উৎপাদকদের রক্ষার ঘোষণা দেন। সেই প্রেক্ষিতেই চীনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পণ্যের ওপর ৩৪ শতাংশ আমদানি শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন তিনি।

চীনের প্রতিক্রিয়া ছিল প্রত্যাশিতভাবেই কঠোর। পাল্টা শুল্ক আরোপ করে বেইজিংও জানিয়ে দেয়, যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিপণ্য ও প্রযুক্তিপণ্য আমদানির ক্ষেত্রে একইভাবে উচ্চ হারে শুল্ক আরোপ করা হবে। এই প্রতিযোগিতামূলক শুল্কারোপের ফলেই বাণিজ্য যুদ্ধের আগুন আরও দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে।

একের পর এক শুল্ক বৃদ্ধির ঘোষণা

প্রথম দফার শুল্ক আরোপের পরও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছিল, বাণিজ্য ভারসাম্য রক্ষায় চীনের ভূমিকা সন্তোষজনক নয়। ট্রাম্প প্রশাসন স্পষ্ট জানায়, চীনের ‘অন্যায্য বাণিজ্যিক সুবিধা’ এবং ‘প্রযুক্তি চুরি’ বন্ধ না হলে শুল্কের হার আরও বাড়ানো হবে।

এরই ধারাবাহিকতায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দ্বিতীয় দফায় চীনা পণ্যের ওপর অতিরিক্ত ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন। এতে মোট শুল্কের হার গিয়ে দাঁড়ায় ৮৪ শতাংশে। যদিও এই হার যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি করা চীনা পণ্যের প্রতিযোগিতা অনেকাংশেই কমিয়ে দেয়, তারপরও ট্রাম্প প্রশাসন তৃতীয় দফায় শুল্ক বাড়িয়ে তা ১২৫ শতাংশে উন্নীত করে।

প্রতিশোধমূলক পাল্টা পদক্ষেপ

চীনও বসে থাকেনি। শুল্ক যুদ্ধের পাল্টা কৌশল হিসেবে বেইজিং যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিপণ্য, প্রযুক্তিপণ্য এবং বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যের ওপর আমদানি শুল্ক বাড়িয়ে ১২৫ শতাংশ নির্ধারণ করে। এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হওয়ার পর মার্কিন অর্থনীতিতে চাপ অনুভূত হয়। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষকরা এবং প্রযুক্তি খাত এই শুল্কের নেতিবাচক প্রভাব প্রত্যক্ষ করতে শুরু করে।

চীনের এই পদক্ষেপের পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আরও একবার শুল্ক বৃদ্ধির ঘোষণা দেন। এবং সবশেষে ১৫ এপ্রিল মঙ্গলবার হোয়াইট হাউস থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে জানানো হয়, চীনের প্রতিশোধমূলক শুল্কের প্রতিক্রিয়া হিসেবে এবার চীনা পণ্যের ওপর আমদানি শুল্ক বাড়িয়ে ২৪৫ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে।

‘আমেরিকা ফার্স্ট ট্রেড পলিসি’র অংশ

হোয়াইট হাউসের বিবৃতিতে স্পষ্ট বলা হয়েছে, “চীনের প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির জন্য হুমকি হয়ে উঠছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নেতৃত্বে আমেরিকান শিল্প, কর্মসংস্থান এবং প্রযুক্তিকে রক্ষা করতে আমরা প্রতিশোধমূলক শুল্কের মাধ্যমে কঠোর বার্তা দিচ্ছি। এই শুল্ক বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত ‘আমেরিকা ফার্স্ট ট্রেড পলিসি’র অংশ।”

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ব্যক্তিগতভাবে এই নীতিকে ‘জাতীয় স্বার্থ রক্ষার একমাত্র কার্যকর পন্থা’ বলে উল্লেখ করেছেন। তার দাবি, “আমরা আর চীনের অন্যায্য বাণিজ্য নীতির শিকার হতে পারি না। আমেরিকার অর্থনীতি, কর্মসংস্থান এবং শিল্পকে সুরক্ষা দিতে আমরা প্রয়োজনে আরও কঠোর সিদ্ধান্ত নেব।”

বৈশ্বিক অর্থনীতির শঙ্কা

বিশেষজ্ঞদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের এই চলমান বাণিজ্য যুদ্ধ শুধু দুই দেশের অর্থনীতির ওপর নয়, বরং বৈশ্বিক বাণিজ্য কাঠামোর ওপর দীর্ঘস্থায়ী নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) ইতোমধ্যেই এই ধরনের শুল্ক যুদ্ধে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সংস্থাটির মতে, এই ধরনের পদক্ষেপ বিশ্ব অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতার জন্য বড় হুমকি তৈরি করছে।

বাণিজ্য বিশ্লেষক ডেভিড ব্রাউন বলেন, “এই শুল্ক যুদ্ধ দুই দেশের জন্যই ক্ষতিকর হতে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রে পণ্যের দাম বাড়বে, যা ভোক্তাদের জন্য বাড়তি চাপ তৈরি করবে। একই সঙ্গে চীনের রপ্তানি খাতও ধাক্কা খাবে, যার প্রভাব বিশ্বব্যাপী বাজারে পড়বে।”

চীনের সম্ভাব্য পরবর্তী পদক্ষেপ

চীনের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এই শুল্ক বৃদ্ধির পরও এখনো নতুন কোনো প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ ঘোষণা করা হয়নি। তবে বেইজিংয়ের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র বলেছেন, “যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্ত বাণিজ্যিক পারস্পরিক সম্মানের পরিপন্থী। চীনও প্রয়োজনীয় পাল্টা ব্যবস্থা নেবে এবং নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় সমস্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।”

বিশ্লেষকদের ধারণা, চীন হয়তো যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা কৃষিপণ্য, প্রযুক্তিপণ্য এবং যানবাহনের ওপর আরও কঠোর শুল্ক আরোপ করতে পারে। পাশাপাশি তারা অন্য বাণিজ্য অংশীদারদের সঙ্গে চুক্তি বাড়িয়ে মার্কিন বাজারের বিকল্প খোঁজার দিকেও নজর দিতে পারে।

রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও আসন্ন নির্বাচন

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আসন্ন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে ট্রাম্পের এই কঠোর শুল্কনীতি অনেকটাই রাজনৈতিক কৌশলের অংশ। ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ বার্তার মাধ্যমে তিনি মধ্যবিত্ত ও কৃষিজীবী ভোটারদের সমর্থন পেতে চাইছেন। তবে এর পরিণতি কতটা ইতিবাচক হবে, তা সময়ই বলবে।

একইসঙ্গে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকেরা সতর্ক করছেন, এই বাণিজ্য যুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদে বিশ্ব অর্থনীতির ওপর চরম চাপ তৈরি করতে পারে। এতে বাজারে অস্থিরতা বাড়বে, বিনিয়োগে ধীরগতি আসবে এবং বিশ্বজুড়ে মুদ্রাস্ফীতির আশঙ্কাও উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button