অর্থনীতি

২০০ বিনিয়োগকারীসহ বাংলাদেশে আসছেন চীনা বাণিজ্য মন্ত্রী

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হতে যাচ্ছে। আগামী মাসে বাংলাদেশ সফরে আসছেন চীনের বাণিজ্য মন্ত্রী, সঙ্গে থাকছেন প্রায় ২০০ জন বিশিষ্ট চীনা বিনিয়োগকারী। এই সফরকে কেন্দ্র করে দুই দেশের অর্থনৈতিক সহযোগিতা নতুন উচ্চতায় পৌঁছাবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বুধবার (৯ এপ্রিল) ঢাকায় চলমান আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সম্মেলনের তৃতীয় দিনের শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী এই তথ্য জানান। তিনি বলেন, “চীনের বাণিজ্যমন্ত্রীর এই সফর আমাদের অর্থনীতির জন্য একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হতে পারে। এই সফরের মাধ্যমে বহুজাতিক বিনিয়োগকারীরা সরাসরি বাংলাদেশের শিল্প খাত পরিদর্শনের সুযোগ পাবেন এবং প্রতিশ্রুত বিনিয়োগ চূড়ান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে।”

চীনা বিনিয়োগ: বড় চুক্তির ইঙ্গিত

আশিক চৌধুরী জানান, ইতোমধ্যে চীনের হানডা কোম্পানির সাথে বাংলাদেশে দেড়শো কোটি ডলারের একটি বিনিয়োগ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এই চুক্তি মূলত দেশের উৎপাদন খাত, বিশেষত প্রযুক্তি এবং ভারী যন্ত্রাংশ শিল্পে বিনিয়োগ কেন্দ্রীভূত করবে। হানডা কোম্পানি এমন একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান, যারা বৈশ্বিক বাজারে আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর উৎপাদন প্রক্রিয়ায় বিশেষ দক্ষতা রাখে।

চুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশে একটি পূর্ণাঙ্গ উৎপাদন প্ল্যান্ট স্থাপন করা হবে, যেখানে দেশীয় জনশক্তিকে প্রশিক্ষণ দিয়ে কারিগরি দক্ষতাও বাড়ানো হবে। এটি দেশের যুবসমাজের কর্মসংস্থানের একটি বড় সুযোগ সৃষ্টি করবে বলেও মন্তব্য করেন বিডা চেয়ারম্যান।

প্রতিরক্ষা শিল্পে নতুন দিগন্ত

সরকারের নতুন কৌশলের অংশ হিসেবে এবার প্রতিরক্ষা শিল্পে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (FDI) আকর্ষণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। আশিক চৌধুরী বলেন, “আমরা এমন বিনিয়োগকারী চাই, যারা কেবল প্রযুক্তিগত সহায়তা দেবে না, বরং দেশে বসেই পূর্ণাঙ্গ উৎপাদন প্রক্রিয়া চালাবে।”

এই লক্ষ্যে ‘মিলিটারি ইকোনমিক জোন’ নামে আলাদা অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠনের চিন্তাভাবনা চলছে। যেখানে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম উৎপাদন এবং রপ্তানির সুবিধা নিশ্চিত করা হবে। এমন উদ্যোগ দক্ষিণ এশিয়ায় একটি নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে।

আইএলও ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব

চীনা বিনিয়োগের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এর সঙ্গেও একটি গুরুত্বপূর্ণ সমঝোতা চুক্তি হয়েছে বলে জানান বিডা চেয়ারম্যান। এই চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের শ্রমবাজার আরও দক্ষ, টেকসই এবং আন্তর্জাতিক মানসম্মত করার প্রচেষ্টা নেওয়া হবে। বিশেষ করে, টেক্সটাইল ও তৈরি পোশাক খাতে শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ, নিরাপত্তা ও কর্মপরিবেশ উন্নয়নে এই অংশীদারিত্ব ভূমিকা রাখবে।

তরুণ উদ্যোক্তাদের প্রদর্শনী

বিনিয়োগ সম্মেলনের তৃতীয় দিন তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য একটি পৃথক প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়, যেখানে প্রায় ৩০টি স্টার্টআপ অংশ নেয়। বস্ত্র, কৃষি উপকরণ, শিক্ষা প্রযুক্তি, খাদ্য ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) প্রযুক্তিভিত্তিক বিভিন্ন পণ্য ও সেবা প্রদর্শন করেন উদ্যোক্তারা।

প্রদর্শনীতে অংশ নেওয়া এক উদ্যোক্তা জানান, “এমন আয়োজন আমাদের মতো নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা বিনিয়োগকারীদের সামনে আমাদের পণ্য তুলে ধরার সুযোগ পেয়েছি, যা ভবিষ্যতে বড় কোনো বিনিয়োগে রূপ নিতে পারে।”

আরব আমিরাতের আগ্রহ: ফ্রি ট্রেড জোন

এদিকে, সংযুক্ত আরব আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ড গ্রুপ বাংলাদেশে একটি ফ্রি ট্রেড জোন স্থাপনের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এই জোনটি কক্সবাজারের মাতারবাড়ি অঞ্চলে স্থাপনের চিন্তাভাবনা রয়েছে। সমুদ্রবন্দরের কাছাকাছি এই এলাকাটি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং এটি দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্যিক হাব হিসেবে গড়ে উঠতে পারে বলে ধারণা বিশ্লেষকদের।

ডিপি ওয়ার্ল্ড গ্রুপের এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক লজিস্টিকস ও ট্রানজিট সেবার ক্ষেত্রে একটি বড় উত্তরণ ঘটাতে পারবে। পাশাপাশি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যিক সংযোগ আরও মজবুত হবে।

ভবিষ্যৎ প্রত্যাশা ও চ্যালেঞ্জ

চীন, আরব আমিরাতসহ অন্যান্য দেশের বিনিয়োগ আগ্রহ ইতিবাচক হলেও, এই বিনিয়োগ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। যেমন, দ্রুত অনুমোদন প্রক্রিয়া, অবকাঠামো উন্নয়ন, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ, দক্ষ জনবল এবং প্রশাসনিক স্বচ্ছতা।

বিডা চেয়ারম্যান আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, “আমরা এসব চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করেছি এবং একটি সমন্বিত পরিকল্পনা অনুযায়ী এগোচ্ছি। ভবিষ্যতে বাংলাদেশ বিদেশি বিনিয়োগের জন্য দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম আকর্ষণীয় গন্তব্য হয়ে উঠবে।”

উপসংহার

চীনা বাণিজ্যমন্ত্রীর এই সফর এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিনিয়োগ উদ্যোগগুলো নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় একটি নতুন অধ্যায় রচনা করবে। আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে সুদৃঢ় সম্পর্ক, তরুণ উদ্যোক্তাদের অগ্রগতি এবং নতুন শিল্পখাতে বৈদেশিক বিনিয়োগ— সব মিলিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এক আশাব্যঞ্জক পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এখন সময় সেই সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button