ইয়েমেনের সাম্প্রতিক ইসরায়েলি হামলা বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন উত্তেজনার জন্ম দিয়েছে। সোমবার ভোরে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী ইয়েমেনের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর — হুদেইদাহ, হোসেইন, রাস ইসা ও সালিফ — এবং একটি প্রধান বিদ্যুৎকেন্দ্রে শক্তিশালী হামলা চালায়। এই হামলায় তাত্ক্ষণিক কোনো হতাহতের খবর পাওয়া না গেলেও, স্থানীয় বিদ্যুৎকেন্দ্র বিধ্বস্ত হওয়ায় হুদেইদাহ শহর পুরোপুরি অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছে।
ইসরায়েলের হামলার পটভূমি ও উদ্দেশ্য
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, এই হামলা হুতিদের ‘সন্ত্রাসী’ শাসন কাঠামোকে দুর্বল করতে এবং তাদের সামরিক সক্ষমতা ভেঙে দিতে পরিকল্পিত। ২০২৩ সালের অক্টোবরে গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার হামলার পর থেকে হুতিরা ইসরায়েলের ভূখণ্ডে ও লোহিত সাগরে তাদের সমর্থকদের বাণিজ্যিক জাহাজ লক্ষ্য করে একাধিক হামলা চালিয়ে আসছে। এর ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও সমুদ্রপথের নিরাপত্তা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
হুতিরা ইরান সমর্থিত হিসেবে পরিচিত, এবং তারা গাজা বেসিনের ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি তাদের সমর্থন প্রকাশ করেছে। এই কারণে ইসরায়েল হুতিদের বিরুদ্ধে একের পর এক প্রতিহিংসামূলক অভিযান চালাচ্ছে।
হামলার বিস্তারিত
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, হুদেইদাহ বন্দরের ‘গ্যালাক্সি লিডার’ নামের একটি জাহাজ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে, যেটি ২০২৩ সালের শেষ দিকে হুতিদের হাতে দখল হয়েছিল। হুতিরা ওই জাহাজে একটি অত্যাধুনিক রাডার সিস্টেম স্থাপন করেছিল, যা আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমায় নৌযান শনাক্তকরণে ব্যবহৃত হচ্ছিল এবং হুতিদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম প্রচারের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছিল।
এছাড়াও হামলা চালানো হয়েছে রাস কান্তিব বিদ্যুৎকেন্দ্রেও, যার ফলে হুদেইদাহ শহরের বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, তারা অন্ধকারে গভীর উদ্বেগে দিন কাটাচ্ছেন।
হুতিদের পাল্টা প্রতিক্রিয়া ও সামরিক সক্ষমতা
হুতিদের সামরিক মুখপাত্র জানান, তারা স্থানীয়ভাবে তৈরি ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে ইসরায়েলের হামলা প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছে। ইসরায়েলের বেশির ভাগ ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ব্যবহার করে ধ্বংস করা হয়েছে।
হুতিদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই হামলা তাদের যুদ্ধের প্রেরণা আরও শক্তিশালী করেছে এবং তারা তাদের ‘স্বাধীনতা ও প্রতিরক্ষা সংগ্রাম’ অব্যাহত রাখবে।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট ও ভবিষ্যৎ প্রভাব
ইসরায়েল-হুতির সংঘর্ষ মধ্যপ্রাচ্যের জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন মোড় এনেছে। গাজা থেকে শুরু করে ইয়েমেন পর্যন্ত উত্তেজনা বৃদ্ধি পেলে বিশ্ব বাজারে তেল এবং সমুদ্রপথ নিরাপত্তা ব্যাপক প্রভাবিত হতে পারে। আন্তর্জাতিক মহল এই পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং শান্তির আহ্বান জানিয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই হামলা মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের প্রভাব বাড়ানোর এবং হুতিদের সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তি কমানোর একটি অংশ। অন্যদিকে, হুতিরা তাদের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বাড়িয়ে ইসরায়েলের আগ্রাসনের মোকাবিলা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
ইয়েমেনের বন্দরগুলোর গুরুত্ব
হুদেইদাহ, হোসেইন, রাস ইসা ও সালিফ বন্দরের অবস্থান কৌশলগত দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লোহিত সাগরের তীরে অবস্থিত এই বন্দরগুলো আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত। হামলার ফলে বিশ্ব বাণিজ্য চেইনে বড় ধরনের বিঘ্ন ঘটতে পারে।
বিশেষত হুদেইদাহ বন্দরটি হুতিদের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকা থেকে খাদ্য ও চিকিৎসা সামগ্রী আমদানি করার প্রধান রুট। এই বন্দর অচল হওয়ার ফলে ইয়েমেনের সংকটময় মানবিক পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে।
ভবিষ্যৎ দৃষ্টিভঙ্গি
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর এই হামলা নতুন একটি পর্যায়ে মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতকে নিয়ে এসেছে। ইয়েমেনের বন্দরগুলো এবং বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে আঘাত হুতিদের সামরিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতাকে দুর্বল করতে সক্ষম হবে কিনা, তা ভবিষ্যতের প্রশ্ন। তবে এতে এলাকায় মানবিক সংকট আরও বাড়বে বলেই আশঙ্কা।
বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে শান্তি ও সমঝোতার আহ্বান করা ছাড়াও, সংঘাতস্থলগুলোতে অবিলম্বে মানবিক সহায়তা পৌঁছানো জরুরি হয়ে পড়েছে। ইয়েমেনের সাধারণ মানুষ ইতিমধ্যে বহু বছর ধরে চলমান যুদ্ধ ও সংকটের শিকার, তাদের জীবন ও নিরাপত্তার জন্য দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক।



