পাল্টা শুল্ক তিন মাস স্থগিতের অনুরোধ করে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে চিঠি দিলেন প্রধান উপদেষ্টা

যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপের পরিপ্রেক্ষিতে দেশজুড়ে গভীর উদ্বেগ তৈরি হয়। এ সংকটময় পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক পদক্ষেপ হিসেবে আজ সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে একটি আনুষ্ঠানিক চিঠি দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। চিঠিতে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত পাল্টা শুল্ক তিন মাসের জন্য স্থগিত রাখার অনুরোধ জানিয়েছেন।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ঢাকায় বিনিয়োগ সম্মেলনের সংবাদ সম্মেলনে বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, “প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে একটি কূটনৈতিক চিঠি দিয়েছেন। এই চিঠি ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করা হবে।”
চিঠিতে মূলত যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ বাণিজ্য সম্পর্কে ভারসাম্য রক্ষায় বাংলাদেশের গৃহীত পদক্ষেপ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা তুলে ধরা হয়েছে। অধ্যাপক ইউনূস বলেন, “আমরা আগামী প্রান্তিকের মধ্যে আমাদের পরিকল্পনা অনুসারে কার্যক্রম শেষ করব। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে পরামর্শ সভা করার জন্য সময় প্রার্থনা করছি। সেই সঙ্গে অনুরোধ করছি, পাল্টা শুল্ক আরোপের কার্যকারিতা অন্তত তিন মাসের জন্য স্থগিত রাখা হোক।”
চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি বৃদ্ধিতে সহায়তার জন্য বাংলাদেশ প্রস্তুত রয়েছে। গ্যাস টারবাইন, সেমিকন্ডাক্টর এবং চিকিৎসাসামগ্রীর মতো যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান রপ্তানি পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক হ্রাসের প্রস্তাব ইতোমধ্যে বিবেচনায় আনা হয়েছে। এছাড়া কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের তুলা, গম, সয়াবিন, ভুট্টার মতো প্রধান কৃষিপণ্য আমদানির বিষয়েও ইতিবাচক অবস্থান গ্রহণ করেছে।
চিঠিতে বলা হয়, “বাংলাদেশ সরকার বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের তুলা রপ্তানিতে সহায়তা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই উদ্যোগ সম্পূর্ণ শুল্কমুক্ত সুবিধা হিসেবে কার্যকর হবে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষকরা সরাসরি লাভবান হবেন এবং উভয় দেশের মধ্যে পারস্পরিক বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হবে।”
বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছেন বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, “বাংলাদেশের বাণিজ্য উপদেষ্টা পুরো বিষয়টি তত্ত্বাবধান করছেন এবং নন-ট্যারিফ বাধাসমূহ দূর করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে। পণ্যের মান পরীক্ষাসহ লেবেলিং, সনদপত্র ইত্যাদি বিষয়ে ছাড় দেওয়া হচ্ছে, যাতে শুল্কায়ন প্রক্রিয়া আরও সহজ ও গতিশীল হয়।”
যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশের সম্ভাবনা এবং সহযোগিতার প্রসঙ্গও চিঠিতে স্থান পেয়েছে। স্টারলিংকের বাংলাদেশে কার্যক্রম শুরুর বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বলেও অধ্যাপক ইউনূস ডোনাল্ড ট্রাম্পকে জানিয়েছেন। তিনি লেখেন, “বেসামরিক বিমান চলাচল, সামরিক খাত এবং উন্নত প্রযুক্তির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে একটি নতুন বাণিজ্যিক যুগের সূচনা হতে যাচ্ছে।”
উল্লেখ্য, গত বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্বের একাধিক দেশের পণ্যের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন। এতে বাংলাদেশের পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়, যা দেশীয় রপ্তানিকারকদের জন্য এক বড় ধাক্কা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপ মূলত বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর কৌশলের অংশ। যেসব দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি বেশি, তাদের ওপর অধিক হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্যিক মহলে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশেও ব্যবসায়ী মহল এবং সরকারি উচ্চপর্যায়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। দেশীয় তৈরি পোশাক, চামড়া, হস্তশিল্প ও তথ্যপ্রযুক্তি পণ্য রপ্তানিতে এই শুল্কের প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রধান উপদেষ্টার এই চিঠি কেবল একটি কূটনৈতিক পদক্ষেপ নয়, বরং তা একটি সময়োপযোগী বাণিজ্য রক্ষা উদ্যোগ বলেই বিশ্লেষকদের মত। তারা বলছেন, অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে এমন পদক্ষেপ ভবিষ্যতে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নে সহায়ক হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ বাণিজ্যিক সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরে বন্ধুত্বপূর্ণ ও অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়ে আসছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে এই সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষায় কূটনৈতিক সংলাপ ও যৌথ পরিকল্পনা অত্যন্ত জরুরি। প্রধান উপদেষ্টার চিঠি সেই লক্ষ্যে একটি দৃঢ় ও সুসংহত উদ্যোগ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এখন দেখার বিষয়, ট্রাম্প প্রশাসন এ চিঠির কী প্রতিক্রিয়া জানায় এবং শুল্ক নীতিতে কী ধরনের নমনীয়তা প্রদর্শন করে। ভবিষ্যতের বাণিজ্যনীতি ও কৌশল নির্ধারণে এই চিঠি গুরুত্বপূর্ণ একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।