অর্থনীতি

এনবিআরকে স্থলবন্দর দিয়ে সুতা আমদানি বন্ধের প্রস্তাব বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের

বাংলাদেশের পোশাকশিল্পে দেশীয় সুতার ব্যবহার বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে স্থলবন্দর দিয়ে পোশাকশিল্পের অন্যতম কাঁচামাল সুতা আমদানি বন্ধ করার জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) ব্যবস্থা নিতে বলেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার একটি চিঠির মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রজ্ঞাপন জারি বা বিদ্যমান প্রজ্ঞাপনে সংশোধনী আনার সুপারিশ করা হয়েছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়েছে, চীন, তুরস্ক, উজবেকিস্তান এবং দেশীয় মিলগুলোতে উৎপাদিত সুতার দাম প্রায় একই হলেও স্থলবন্দর দিয়ে আসা ভারতীয় সুতার দাম তুলনামূলকভাবে কম। ফলে অনেক গার্মেন্টস শিল্প স্থলবন্দর হয়ে আমদানি করা সস্তা সুতা ব্যবহারে ঝুঁকছে, যা দেশীয় সুতার বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

এই অবস্থার ফলে দেশের সুতা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না। এতে বাংলাদেশের টেক্সটাইল মিলগুলোর উৎপাদন ও ব্যবসায়িক কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় মনে করে, স্থলবন্দর দিয়ে সুতা আমদানি বন্ধ হলে স্থানীয় টেক্সটাইল খাতের উন্নয়ন হবে এবং দেশীয় সুতা উৎপাদন আরও লাভজনক হবে।

বিটিএমএর দাবি

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) এর আগে গত ফেব্রুয়ারি মাসে স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে সুতা আমদানি বন্ধের দাবি জানায়। সংগঠনটি যুক্তি দেয় যে, ভারতের উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চলে উৎপাদিত সুতা প্রথমে কলকাতায় গুদামজাত করা হয়, তারপর সেখান থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। কম দামে আসার ফলে স্থানীয় টেক্সটাইল কারখানাগুলো ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ছে।

বিটিএমএ সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদকে পাঠানো এক চিঠিতে উল্লেখ করেন যে, স্থলবন্দর দিয়ে আসা সুতার মান যাচাই ও শুল্কায়নের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও কারিগরি সক্ষমতা নেই। এর ফলে ন্যায্য শুল্ক আদায় করা সম্ভব হয় না এবং বাজারে অসম প্রতিযোগিতা তৈরি হয়। তিনি আরও জানান, স্থলবন্দরে চালান বিভক্ত করার সুযোগের অপব্যবহার হচ্ছে, যা স্থানীয় মিলগুলোর জন্য আরও বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

টেক্সটাইল খাতের সংকট ও সম্ভাবনা

বাংলাদেশের টেক্সটাইল খাত দেশের অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক চালিকা শক্তি। বর্তমানে প্রায় ১,৫০০ টেক্সটাইল মিল দেশীয় বাজারে সুতা উৎপাদন করছে। এই খাতে বিনিয়োগ ও উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য স্থানীয় কারখানাগুলোর সুরক্ষা প্রয়োজন।

টেক্সটাইল বিশেষজ্ঞদের মতে, সুতা আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হলে দেশের সুতা উৎপাদকরা আরও লাভজনক ব্যবসা করতে পারবে এবং বাংলাদেশ পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে আরও শক্তিশালী অবস্থান নিতে পারবে।

পোশাকশিল্পে সম্ভাব্য প্রভাব

স্থলবন্দর দিয়ে সুতা আমদানি বন্ধ হলে স্থানীয় টেক্সটাইল মিলগুলোর ব্যবসা বাড়বে, তবে কিছু পোশাক কারখানার উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যেতে পারে। বিশেষত, যেসব কারখানা কম দামে ভারতীয় সুতা ব্যবহার করছিল, তাদের ব্যয় বেড়ে গেলে পোশাকের রপ্তানি প্রতিযোগিতায় প্রভাব পড়তে পারে।

তবে বিশ্লেষকদের মতে, দেশীয় টেক্সটাইল শিল্পের বিকাশ হলে দীর্ঘমেয়াদে পোশাকশিল্পের জন্যও তা ইতিবাচক হবে। দেশের সুতা উৎপাদন বাড়লে ভবিষ্যতে পোশাকশিল্পের উপর নির্ভরশীলতা কমবে এবং বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে।

সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ ও সরকারী নীতিমালা

এনবিআর যদি স্থলবন্দর দিয়ে সুতা আমদানি বন্ধ করে, তবে এর বাস্তবায়নে কিছু চ্যালেঞ্জ দেখা দিতে পারে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশীয় টেক্সটাইল মিলগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানো এবং দাম সহনীয় রাখার জন্য সরকারকে বিশেষ নীতিমালা গ্রহণ করতে হবে।

এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তার বক্তব্য, ‘আমরা স্থানীয় টেক্সটাইল শিল্পকে রক্ষা করতে চাই, তবে পোশাকশিল্পের প্রতিযোগিতামূলক বাজারও আমাদের নজরে রাখতে হবে। তাই এই নীতির বাস্তবায়ন ধাপে ধাপে করার বিষয়টিও বিবেচনায় আছে।’

উপসংহার

বাংলাদেশের টেক্সটাইল খাতের উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এই সুপারিশ গুরুত্বপূর্ণ। স্থলবন্দর দিয়ে সস্তা সুতা আমদানি বন্ধ হলে দেশীয় উৎপাদনকারীরা লাভবান হবে, তবে এর ফলে পোশাকশিল্পের কাঁচামালের ব্যয়ও বেড়ে যেতে পারে।

সরকার যদি একটি ভারসাম্যপূর্ণ নীতিমালা প্রণয়ন করে, তবে সুতা আমদানির নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি স্থানীয় শিল্পের বিকাশ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। এর ফলে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের টেক্সটাইল ও পোশাকশিল্পের মধ্যে সুসংগতি বজায় থাকবে এবং দেশীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button