অর্থনীতি

পায়রা বন্দর: অর্থনৈতিক সম্ভাবনা নাকি ব্যয়বহুল বোঝা

বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত পায়রা সমুদ্রবন্দর দেশের তৃতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা করা হয়েছে। তবে এটি অর্থনীতির জন্য একটি ‘বিষফোড়া’ হয়ে উঠতে পারে বলে মত দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। তাঁর মতে, পায়রা বন্দরের টেকসই পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণে বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হবে, যা দীর্ঘমেয়াদে দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

বন্দরের বর্তমান অবস্থা ও পরিকল্পনা

পায়রা বন্দর প্রকল্পটি চালু করা হয় দেশের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম সম্প্রসারণ ও দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে কেন্দ্র করে। এটি মূলত একটি গভীর সমুদ্রবন্দর হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। তবে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন ও পরিচালনা সংক্রান্ত নানা জটিলতার কারণে এটি নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।

পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, “পায়রা সমুদ্রবন্দর বলা হলেও এটি মূলত একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লা আনতেই ব্যবহার করা হচ্ছে। এটি কার্যত কোনো পূর্ণাঙ্গ সমুদ্রবন্দর নয়, বরং একটি ঘাটের মতো হয়ে উঠতে পারে।” তিনি আরও জানান, বন্দরটি সচল রাখতে প্রতি বছর দুটি ড্রেজার পরিচালনা করতে হবে, যা রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে তুলবে।

ব্যয় ও অর্থনৈতিক প্রভাব

পায়রা বন্দরের উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য সরকার এখন পর্যন্ত প্রায় ৭২ শতাংশ কাজ সম্পন্ন করেছে এবং প্রকল্পের অর্ধেকের বেশি বাজেট ইতোমধ্যে ব্যয় হয়ে গেছে। প্রকল্প সংশোধন এবং অতিরিক্ত খরচের বিষয়টি একনেক (জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি) সভায় আলোচনা করা হয়। একনেকের অনুমোদিত সংশোধিত প্রকল্প ব্যয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২১,১৩৯ কোটি ৪৫ লাখ টাকা, যার মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে ১৪,১৯৩ কোটি, বৈদেশিক ঋণ থেকে ৬,৫৩৯ কোটি ২৯ লাখ এবং সংস্থার নিজস্ব তহবিল থেকে ৪০৬ কোটি ৫৬ লাখ টাকা ব্যয় করা হবে।

অর্থনীতিবিদদের মতে, এত বড় পরিমাণ বিনিয়োগের পরও বন্দরের অর্থনৈতিক সাফল্য অনিশ্চিত থাকলে তা দেশের অর্থনীতির জন্য দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিকর হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই বন্দর থেকে রাজস্ব আয় যথাযথ না হলে সরকারের ওপর ঋণের চাপ বাড়তে পারে, যা ভবিষ্যতে বাজেট ঘাটতির কারণ হতে পারে।

পরিকল্পনা উপদেষ্টার পর্যবেক্ষণ

পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, “যদি শুরুতেই প্রকল্পের সব দিক বিবেচনা করা হতো, তাহলে হয়তো এটি গ্রহণ করা হতো না। এখন মাঝপথে এসে প্রকল্পটি বন্ধ করা হবে কি না, সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।” তিনি জানান, তাঁর নেতৃত্বে একটি দল সরেজমিনে পায়রা বন্দর পরিদর্শন করে প্রকল্পটির সম্ভাবনা ও সীমাবদ্ধতা মূল্যায়ন করবে। মূল্যায়ন প্রতিবেদনের ভিত্তিতে প্রকল্পটির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করা হবে।

বন্দরের ভবিষ্যৎ ও উন্নয়ন সম্ভাবনা

সরকার পায়রা বন্দরের সম্ভাবনা নিয়ে আশাবাদী হলেও বিশেষজ্ঞদের মতে, বন্দরের দীর্ঘমেয়াদি কার্যকারিতা ও টেকসই পরিচালনার জন্য সুস্পষ্ট কৌশল গ্রহণ করা জরুরি। বিশেষ করে, যদি এটি শুধুমাত্র কয়লা আমদানির জন্য ব্যবহার করা হয়, তবে অর্থনৈতিকভাবে এটি টেকসই হবে না।

পরিকল্পনাবিদদের মতে, পায়রা বন্দরের কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করতে হলে এটি মাল্টিপারপাস বন্দর হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। কন্টেইনার টার্মিনাল, শিল্প কারখানার আমদানি-রপ্তানি সুবিধা বৃদ্ধি এবং দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনৈতিক করিডোর উন্নয়নের মতো বিষয়গুলোর ওপর জোর দিতে হবে। পাশাপাশি, বন্দরের পরিচালন ব্যয় কমানোর জন্য উন্নত ড্রেজিং প্রযুক্তি এবং কার্যকর অবকাঠামো ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে।

একনেক সভার সিদ্ধান্ত

আজ রোববার একনেক সভায় পায়রা বন্দর প্রকল্পসহ ১৫টি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এসব প্রকল্পের মধ্যে পায়রা বন্দর প্রকল্প সংশোধনের বিষয়টিও আলোচনায় আসে। সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।

সরকারি নীতিনির্ধারকদের মতে, পায়রা বন্দরের কার্যকর ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা গেলে এটি দক্ষিণাঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পায়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে একনেক সভার আলোচনায় অর্থনীতিবিদরা বন্দরের উচ্চ ব্যয় এবং দীর্ঘমেয়াদী টেকসইতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

উপসংহার

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য পায়রা বন্দরের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, তবে এর কার্যকারিতা ও ব্যয় ব্যবস্থাপনা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের আগে যদি পর্যাপ্ত অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ করা হতো, তাহলে হয়তো এত বড় ব্যয়ের বোঝা সৃষ্টি হতো না।

অর্থনীতিবিদদের মতে, সরকার যদি বন্দরের বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারে এবং কার্যকর রক্ষণাবেক্ষণ পরিকল্পনা গ্রহণ করে, তবে এটি একটি লাভজনক বিনিয়োগে পরিণত হতে পারে। অন্যথায়, এটি অর্থনীতির জন্য দীর্ঘমেয়াদে একটি ব্যয়বহুল বোঝা হিসেবেই চিহ্নিত হবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button