অর্থনীতি

কালো টাকা সাদা করার ব্যবস্থা বাতিলের উদ্যোগ : এনবিআর চেয়ারম্যান

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান ঘোষণা করেছেন যে আসন্ন বাজেটে কালো টাকা সাদা করার ব্যবস্থাটি বাতিলের চেষ্টা করা হবে। তবে এটি পুরোপুরি বাতিল করা সম্ভব না হলে করহার বৃদ্ধি করে এটি নিয়মিত করহারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা হবে।

শনিবার রাজধানীর পল্টনে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) মিলনায়তনে এক সভায় এনবিআর চেয়ারম্যান এই কথা বলেন।

কালো টাকা সাদা করার প্রচলিত ব্যবস্থা

বাংলাদেশে কালো টাকা সাদা করার নীতি দীর্ঘদিন ধরে বিতর্কিত বিষয় হয়ে আছে। এই ব্যবস্থায় নির্দিষ্ট হারে কর প্রদান করে অঘোষিত আয়কে বৈধ করার সুযোগ দেওয়া হয়। এ নিয়ে অর্থনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকদের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে মতবিরোধ দেখা গেছে।

এই ব্যবস্থা চালু রাখার পক্ষে যুক্তি দেওয়া হয় যে, এর মাধ্যমে সরকারের রাজস্ব আদায় বাড়ে এবং গোপন সম্পদ বৈধ পথে প্রবাহিত হয়। তবে সমালোচকদের মতে, এটি সৎ করদাতাদের জন্য বৈষম্যমূলক এবং কর ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা বাড়ায়।

নতুন বাজেটে পরিবর্তনের সম্ভাবনা

এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, “আমরা করহারকে স্বাভাবিক করের হারের কাছাকাছি আনতে চাই, যাতে এটি নিয়মিত কর ব্যবস্থা থেকে ভিন্ন না হয়।” তার বক্তব্য ইঙ্গিত দেয় যে আগামী বাজেটে কালো টাকা সাদা করার নীতিতে বড় পরিবর্তন আসতে পারে।

তিনি আরও বলেন, “আমাদের উদ্দেশ্য হল, দেশের সামগ্রিক কর ব্যবস্থাকে স্বচ্ছ ও ন্যায়সঙ্গত করা, যাতে সৎ করদাতারা কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হন।”

অর্থনীতিবিদদের প্রতিক্রিয়া

রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র‌্যাপিড) এবং ইআরএফ আয়োজিত সভায় র‌্যাপিডের নির্বাহী পরিচালক আবু ইউসুফ মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, “কালো টাকা সাদা করার সুবিধা থাকলে কর আদায়ে নৈতিকতার প্রশ্ন ওঠে এবং এতে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।”

অর্থনীতিবিদরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন, এই ব্যবস্থা থাকলে সৎ করদাতারা নিরুৎসাহিত হন এবং যারা কর ফাঁকি দেন, তারা বারবার এই সুযোগ গ্রহণ করেন। তারা মনে করেন, কর ব্যবস্থার স্বচ্ছতা বাড়াতে হলে কালো টাকা সাদা করার বিশেষ সুবিধা বাতিল করা উচিত।

ব্যবসায়ী মহলের প্রতিক্রিয়া

ব্যবসায়ী মহল থেকে কিছু ভিন্নমত উঠে এসেছে। অনেক ব্যবসায়ীর মতে, দেশে কর কাঠামো জটিল এবং কর হার তুলনামূলক বেশি। ফলে অনেকেই কর ফাঁকি দিতে বাধ্য হন। কালো টাকা সাদা করার সুযোগ থাকলে তারা মূলধারার অর্থনীতিতে ফিরে আসতে পারেন।

বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিসিসিআই) এক কর্মকর্তা বলেন, “যদি কর হার কমানো হয় এবং কর ব্যবস্থা সহজ করা হয়, তবে কালো টাকা সাদা করার বিশেষ সুবিধার দরকার থাকবে না।”

আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা

অনেক দেশেই কালো টাকা সাদা করার ব্যবস্থা বিভিন্ন সময়ে চালু করা হয়েছে। তবে বেশিরভাগ উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোতে এই ধরনের সুবিধা বর্তমানে নেই। তাদের কর ব্যবস্থাকে সহজ ও কার্যকর করে তোলার মাধ্যমে সবাইকে কর প্রদানে উৎসাহিত করা হয়।

ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বেশ কয়েকটি দেশ কালো টাকা সাদা করার বিশেষ সুবিধা বন্ধ করে দিয়েছে এবং পরিবর্তে কঠোর নজরদারি ব্যবস্থা চালু করেছে। বাংলাদেশও এই পথে এগোতে চাইছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ নির্দেশনা

এনবিআর-এর সাম্প্রতিক পরিকল্পনাগুলোর মধ্যে রয়েছে কর ব্যবস্থার ডিজিটালাইজেশন, কর ফাঁকি রোধে নজরদারি বৃদ্ধি এবং কর প্রদান সহজতর করা। যদি কালো টাকা সাদা করার সুবিধা বাতিল করা হয়, তাহলে করদাতাদের জন্য বিকল্প সুবিধা প্রদান করা হতে পারে, যেমন কর ছাড়, স্বল্প সুদে ঋণ সুবিধা ইত্যাদি।

এনবিআর চেয়ারম্যানের বক্তব্যের পর বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আসন্ন বাজেটে কালো টাকা সাদা করার ব্যবস্থা হয় সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করা হবে অথবা করহার বৃদ্ধি করে কঠোর শর্ত আরোপ করা হবে। এটি বাস্তবায়িত হলে দেশে কর সংস্কারের একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে পারে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button