রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা: বাংলাদেশে ব্যবসার জন্য বড় ঝুঁকি

ঢাকা, ২০ মার্চ ২০২৫: বাংলাদেশে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতাকে সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে দেখছেন জাপানি বিনিয়োগকারীরা। সম্প্রতি জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশন (জেট্রো) পরিচালিত একটি জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে কাজ করা প্রায় ৯৫ শতাংশ জাপানি কোম্পানি এই ঝুঁকিকে প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তবে, এসব ঝুঁকি সত্ত্বেও সস্তা শ্রম ও বাজার সুবিধার কারণে বাংলাদেশে ব্যবসা সম্প্রসারণের আগ্রহী ৬১ শতাংশ জাপানি কোম্পানি।
জরিপের ফলাফল
জেট্রোর এই জরিপটি এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে কার্যক্রম পরিচালনাকারী জাপানি কোম্পানিগুলোর মতামতের ভিত্তিতে করা হয়েছে। গত বছরের আগস্ট-সেপ্টেম্বরে পরিচালিত এই জরিপে বাংলাদেশে কাজ করা ১৭৫টি জাপানি কোম্পানি তাদের মতামত দিয়েছে। জরিপের ফলাফল সম্প্রতি জেট্রোর ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।
জরিপের ফলাফল অনুযায়ী, ২০২৪ সালে এ অঞ্চলের বেশিরভাগ দেশে জাপানি কোম্পানিগুলোর ব্যবসায়িক আস্থা বেড়েছে এবং মুনাফারও উন্নতি হয়েছে। তবে, স্থানীয় চাহিদা কমে যাওয়ার কারণে চীন ও থাইল্যান্ডের মতো কিছু দেশে তাদের মুনাফা কমেছে। একই সঙ্গে, চীনা ও স্থানীয় কোম্পানিগুলোর কারণে তারা দেশে দেশে তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে পড়ছে।
ব্যবসার জন্য প্রথম পছন্দ ভারত
জরিপে অংশ নেওয়া ১৩,৭২৭টি জাপানি কোম্পানির মধ্যে ভারতকে ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য প্রথম পছন্দ হিসেবে চিহ্নিত করেছে প্রায় ৮০ শতাংশ কোম্পানি। বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। জরিপে অংশ নেওয়া ৫৮ শতাংশ প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, তারা বাংলাদেশে ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে আগ্রহী। যদিও এই হার গত বছরের তুলনায় কিছুটা কমেছে।
সস্তা শ্রম ও বাজার সুবিধা
জাপানি কোম্পানিগুলো জরিপে উল্লেখ করেছে, ব্যবসার পরিবেশের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে পাঁচটি বড় সুবিধা রয়েছে। এগুলো হলো:
- সস্তা শ্রম: ৬১.৩ শতাংশ কোম্পানি এই কারণে বাংলাদেশকে শীর্ষে রেখেছে।
- বাজার সম্ভাবনা: ৬১.৩ শতাংশ কোম্পানি।
- শ্রমিক ও কর্মচারীর সহজপ্রাপ্তি: ২৯.৩ শতাংশ।
- ভাষাগত সুবিধা: ২০ শতাংশ।
- করছাড় ও প্রণোদনা সুবিধা: ১৪.৭ শতাংশ।
এছাড়া, মায়ানমার, লাওস ও শ্রীলঙ্কাকেও সস্তা শ্রমের জন্য এগিয়ে রেখেছে জাপানি কোম্পানিগুলো।
ব্যবসার ঝুঁকি
জরিপে বাংলাদেশে কাজ করা জাপানি কোম্পানিগুলো জানিয়েছে, ব্যবসার পরিবেশের জন্য সবচেয়ে বড় ঝুঁকি রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা। এছাড়া, সরকারের অস্পষ্ট নীতি ব্যবস্থাপনা, বিদ্যুতের অবকাঠামোর ঘাটতি, আইনের অস্পষ্টতা ও জটিলতা এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতা—এই পাঁচটি কারণ বাংলাদেশে ব্যবসা সম্প্রসারণে প্রধান ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
মুনাফা বৃদ্ধির পূর্বাভাস
জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালে বাংলাদেশে কাজ করা ৫০ শতাংশ জাপানি কোম্পানির মুনাফা বাড়তে পারে। অন্যদিকে, চলতি বছর আয়-ব্যয় সমান থাকবে ৪৩.৫ শতাংশ কোম্পানির এবং মুনাফা কমতে পারে ৬.৫ শতাংশ কোম্পানির।
ব্যবসায়িক আস্থা বৃদ্ধি
জরিপে অংশ নেওয়া ৪৩.৫ শতাংশ কোম্পানি মনে করে, বাংলাদেশে আগের তুলনায় ব্যবসায়িক আস্থা বেড়েছে। ব্যবসায়িক আস্থা বৃদ্ধির দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে শ্রীলঙ্কা।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
এ অঞ্চলের অধিকাংশ দেশেই এক–দুই বছরের মধ্যে ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে চায় জাপানি কোম্পানিগুলো। এদিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে ভারত। এরপর বাংলাদেশের অবস্থান। উৎপাদন খাতে ব্যবসা করা জাপানি কোম্পানিগুলো ব্যবসা সম্প্রসারণের বিষয়ে সবচেয়ে বেশি আগ্রহ দেখিয়েছে।
বিশেষজ্ঞের মতামত
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, “বর্তমান পরিস্থিতিতে জাপানি বিনিয়োগকারীদের এমন মন্তব্য স্বাভাবিক। গত জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় থেকে দেশে অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা রয়েছে এবং নতুন সরকারের বৈদেশিক নীতির কিছু পরিবর্তন হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, অবকাঠামো সংকট, দুর্নীতি প্রভৃতি কাঠামোগত সমস্যা আগে থেকেই রয়েছে। এগুলো বিনিয়োগের অন্তরায় হিসেবে কাজ করে। তা সত্ত্বেও বেশিরভাগ জাপানি কোম্পানি এ দেশে ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে চায়। এটি ইতিবাচক।”
বাংলাদেশে ব্যবসার জন্য রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা একটি বড় ঝুঁকি হলেও, সস্তা শ্রম ও বাজার সুবিধার কারণে জাপানি কোম্পানিগুলোর আগ্রহ কমেনি। ভবিষ্যতে ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য তারা বাংলাদেশকে একটি সম্ভাবনাময় দেশ হিসেবে বিবেচনা করছে। তবে, সরকারের নীতি ও ব্যবসার পরিবেশের উন্নতি হলে এই আগ্রহ আরও বাড়তে পারে।
এখন দেখার বিষয় হলো, বাংলাদেশ সরকার এই ঝুঁকিগুলো মোকাবেলা করে কিভাবে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জন করে।