বৈরী আবহাওয়ায় ৫ হাজারের বেশি সাইট ডাউন

দেশজুড়ে বিরূপ আবহাওয়ার কবলে টেলিযোগাযোগ সেবা। নিম্নচাপজনিত প্রবল ঝড়, ভারি বর্ষণ ও জলোচ্ছ্বাসের প্রভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহে ব্যাপক বিঘ্ন ঘটায় টেলিকম অপারেটরদের সাইট বা টাওয়ার বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। এখনো পর্যন্ত প্রায় ৬ হাজার টাওয়ার সচল হয়নি, ফলে দেশের বহু অঞ্চলে মোবাইল নেটওয়ার্ক এবং ইন্টারনেট সংযোগে ব্যাপক ভোগান্তির সৃষ্টি হয়েছে।
শুক্রবার (৩০ মে) বিকেলে এক ফেসবুক পোস্টে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমেদ তৈয়্যব জানান, বৈরী আবহাওয়ার কারণে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় ৫ হাজারের বেশি টেলিকম সাইট অকেজো হয়ে পড়েছে।
তিনি বলেন, “প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হওয়া ও নিরাপত্তাজনিত কারণে মোট ৮ হাজার ২৬২টি টাওয়ার কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা দেশের মোট টাওয়ারের প্রায় ৪৪ শতাংশ। এসব টাওয়ারের মধ্যে ইতোমধ্যে ৬৪ শতাংশ পুনরায় সচল করা গেলেও এখনো ৫ হাজার ৯৬০টি টাওয়ার পুরোপুরি অচল অবস্থায় রয়েছে।”
ক্ষতির বিস্তৃতি: কোথায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব?
বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলোর মধ্যে রয়েছে বরিশাল, সিলেট, টাঙ্গাইল, চাঁদপুর, ময়মনসিংহ, ঢাকা উত্তর, কুমিল্লা, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের উত্তরাঞ্চল। এসব এলাকায় সাইটগুলো দীর্ঘ সময় ধরে বিদ্যুৎহীন থাকায় অপারেটররা বিকল্প পদ্ধতিতে সেবা সচল রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
বিশেষ সহকারী তৈয়্যব জানান, জরুরি ভিত্তিতে মোবাইল অপারেটরদের সহায়তায় ৬২৪টি টাওয়ারে পোর্টেবল জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে। আরও ৫০৪টি টাওয়ারে জেনারেটর বসানোর কাজ চলছে।
গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত অঞ্চল সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে
বিশেষজ্ঞদের মতে, গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিদ্যুৎ সংযোগ দীর্ঘ সময় বিচ্ছিন্ন থাকায় এসব অঞ্চলের টেলিকম সেবা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে সময় লাগবে। বিশেষ করে যেসব এলাকায় বিদ্যুৎ লাইন পুরোটাই ভেঙে পড়েছে, সেখানে টাওয়ারগুলো পুনরায় চালু করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি) সূত্রে জানা গেছে, দেশের মোট টাওয়ারের বড় একটি অংশই গ্রামীণ এলাকায় অবস্থিত। সেখানে টেকনিক্যাল কর্মী পাঠানো, জেনারেটর পৌঁছানো বা বিকল্প সংযোগ স্থাপন করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অপারেটরদের অবস্থা: বিপর্যয় ঠেকাতে হিমশিম
গ্রামীণফোন, রবি, বাংলালিংক ও টেলিটকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তারা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সমন্বিত পদক্ষেপ নিচ্ছেন। বিদ্যুৎ বিভ্রাটের পাশাপাশি লিঙ্ক রাউটিং সমস্যাও দেখা দিয়েছে অনেক এলাকায়, যার ফলে ভয়েস কল ও মোবাইল ইন্টারনেট পরিষেবা বিঘ্নিত হচ্ছে।
একজন অপারেটর কর্মকর্তা বলেন, “ব্যাটারির মেয়াদ নির্দিষ্ট সময়ের পর শেষ হয়ে গেলে টাওয়ার বন্ধ হয়ে যায়। আবার অনেক জায়গায় বন্যার কারণে জেনারেটর নিয়েও পৌঁছানো যাচ্ছে না।”
বৈরী আবহাওয়ার সার্বিক প্রভাব
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, স্থল গভীর নিম্নচাপটি বর্তমানে দুর্বল হতে শুরু করলেও এর প্রভাবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শুক্রবার সকাল থেকেই ভারি বৃষ্টি ও দমকা হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। কোথাও কোথাও জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে, বিশেষ করে শহরাঞ্চলে।
বিভিন্ন জেলার সড়ক যোগাযোগেও এর প্রভাব পড়েছে। কিছু এলাকায় গাছ পড়ে রাস্তাঘাট বন্ধ হয়ে গেছে, ফলে টেলিকম কর্মীদের টাওয়ারে পৌঁছাতে বিলম্ব হচ্ছে।
নেটওয়ার্ক পুনরুদ্ধারে সমন্বিত উদ্যোগ
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রযুক্তি উপদেষ্টার দপ্তর এবং বিটিআরসি একসঙ্গে কাজ করছে পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনতে। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিগুলোকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টাওয়ারের জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ফয়েজ আহমেদ তৈয়্যব জানান, “সাধারণ জনগণের কথা মাথায় রেখেই আমরা নেটওয়ার্ক পুনরুদ্ধারে দিনরাত এক করে কাজ করছি। এই দুর্যোগে সবাইকে ধৈর্য ধরতে হবে এবং একে অপরকে সহযোগিতা করতে হবে।”
নাগরিকদের জন্য করণীয়
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংকটকালীন এ সময়ে মোবাইল ফোন ব্যবহারে সচেতনতা জরুরি। প্রয়োজন ছাড়া ভিডিও স্ট্রিমিং, বড় ফাইল ডাউনলোড ইত্যাদি এড়িয়ে চললে নেটওয়ার্ক চাপ কিছুটা হলেও কমানো সম্ভব।
তারা আরও বলেন, ওয়াই-ফাই সংযোগ থাকলে মোবাইল ডেটা ব্যবহারের পরিবর্তে সেখানেই নির্ভর করা উচিত এবং জরুরি যোগাযোগের ক্ষেত্রে সংক্ষিপ্ত বার্তা বা ভয়েস কলের দিকেই অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।
উপসংহার
বৈরী আবহাওয়ার এমন অভিঘাত সাম্প্রতিক সময়ে বিরল নয়, তবে এবার টেলিযোগাযোগ খাত বিশেষভাবে আক্রান্ত হয়েছে। এ ধরনের দুর্যোগে প্রস্তুতি ও তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার সক্ষমতা বৃদ্ধি করা এখন সময়ের দাবি। টেলিকম খাতকে আরও টেকসই ও ঝুঁকিমুক্ত করতে হলে শুধু অপারেটর নয়, বিদ্যুৎ বিভাগ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয় আরও জোরদার করতে হবে।