নারী উদ্যোক্তাদের বিকাশে বড় বাধা ‘তথ্য ঘাটতি’

বাংলাদেশের নারী উদ্যোক্তাদের অগ্রযাত্রা দিন দিন বাড়লেও তথ্যের অভাবে তারা প্রতিযোগিতামূলক বাজারে নিজেদের যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারছেন না। দেশীয় গ্রাহকদের চাহিদা পূরণ করলেও আন্তর্জাতিক বাজার ধরতে গিয়ে নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছেন উদ্যোক্তারা। বিশেষত, বাজারের চাহিদা, ডিজাইন, পণ্য উন্নয়ন এবং মূল্য নির্ধারণ নিয়ে পর্যাপ্ত তথ্যের অভাবে তারা কাঙ্ক্ষিত সফলতা পাচ্ছেন না বলে মনে করেন উদ্যোক্তা কোহিনুর ইয়াছমিন।
তথ্যের অভাবে পিছিয়ে পড়ছে নারী উদ্যোক্তারা
নারী উদ্যোক্তাদের বিকাশে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে তথ্যের অভাব। কোহিনুর ইয়াছমিন বলেন, “প্রাকৃতিক পণ্যের প্রতি বিদেশি ক্রেতাদের আগ্রহ থাকলেও আমরা এখনও বাজারটা ধরতে পারছি না। গ্রীষ্মকালের বাজার ধরতে হলে ক্রেতাদের ডিজাইন ও প্যাটার্ন সম্পর্কিত তথ্য জানা দরকার। কিন্তু এ ধরনের তথ্য সংগ্রহের জন্য বাংলাদেশে কোনো নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান নেই।”
তিনি আরও বলেন, “প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্ট, ডিজাইন, কস্টিং ও মার্কেট ডিমান্ড নিয়ে উদ্যোক্তাদের প্রচুর গ্যাপ রয়েছে। ফলে অনেক নারী উদ্যোক্তা ঘরে বসে কাজ করলেও কোথায় বিক্রি করবেন, কীভাবে করবেন, কার কাছে পৌঁছাবেন—এসব তথ্যের অভাবে পিছিয়ে পড়ছেন।”
ব্যাংক ঋণ পেতে নারীদের ভোগান্তি
নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর জটিলতা অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার সময় নানা রকম কাগজপত্রের দাবি করা হয়, যা অনেক সময় নারী উদ্যোক্তাদের জন্য চাপের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কোহিনুর ইয়াছমিন বলেন, “একটা ট্যাবু আছে যে নারী উদ্যোক্তারা খুব একটা ভালো কিছু করতে পারবে না। ব্যাংকগুলোর ধারণা, তারা হয়তো ঋণের টাকা ফেরত দিতে পারবে না। এ কারণে নানা অজুহাতে ব্যাংকগুলো কাগজপত্র চেয়ে উদ্যোক্তাদের সময়ক্ষেপণ করে।”
অনেক নারী উদ্যোক্তা এ ধরনের দীর্ঘ প্রক্রিয়ার কারণে ঋণ নেওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। ফলে ব্যবসা সম্প্রসারণের সুযোগ কমে যায় এবং তারা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়েন।
নারী উদ্যোক্তাদের জন্য এফ-কমার্সের সম্ভাবনা
বাংলাদেশে ফেইসবুক-ভিত্তিক ব্যবসা বা এফ-কমার্স নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বড় সম্ভাবনা তৈরি করেছে। তবে এ খাতে কাজ করার ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা এখনও রয়ে গেছে। কোহিনুর ইয়াছমিন মনে করেন, মহামারির পর থেকে এ খাতটি বেশ এগিয়েছে, কিন্তু বিদেশি বাজার থেকে অর্থ আনার ক্ষেত্রে এখনো প্রতিবন্ধকতা রয়েছে।
তিনি বলেন, “অনেক নারী ছোট পরিসরে ব্যবসা শুরু করেছেন এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে নিজেদের পণ্য বিক্রি করছেন। কিন্তু এটি আরও ভালোভাবে পরিচালনার জন্য তাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও গাইডলাইনের প্রয়োজন। যদিও কিছু প্রতিষ্ঠান প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়।”
প্রশিক্ষণের অভাব নারী উদ্যোক্তাদের বড় সমস্যা
নারী উদ্যোক্তাদের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকা জরুরি। তবে একক প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্যোগের পরিবর্তে সমন্বিতভাবে পরিকল্পনা গ্রহণ করলে তা বেশি কার্যকর হবে বলে মনে করেন কোহিনুর।
“নারী উদ্যোক্তাদের জন্য সমন্বিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলে তারা ডিজাইন, প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্ট এবং বিপণন কৌশল সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাবেন। এতে তাদের ব্যবসা পরিচালনা সহজ হবে এবং তারা আন্তর্জাতিক বাজারেও প্রতিযোগিতা করতে সক্ষম হবেন,” বলেন তিনি।
প্রাকৃতিক পণ্যের প্রতি বিদেশিদের আগ্রহ, কিন্তু বাজার ধরতে পারছে না বাংলাদেশ
বিশ্ববাজারে প্রাকৃতিক পণ্যের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তন, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এবং পরিবেশবান্ধব পণ্যের প্রতি বিদেশি ক্রেতাদের আগ্রহ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে তথ্যের অভাবে এবং উপযুক্ত বিপণন কৌশল না থাকায় বাংলাদেশ এখনও এ সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারছে না।
কোহিনুর বলেন, “বিদেশিরা বাংলাদেশের হস্তশিল্প ও প্রাকৃতিক পণ্যের প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছেন। কিন্তু আমরা সেভাবে বাজারটা ধরতে পারছি না। প্রয়োজনীয় তথ্য না থাকার কারণে আমাদের উৎপাদিত পণ্য আন্তর্জাতিক মানের হলেও সঠিকভাবে বিপণন করা সম্ভব হচ্ছে না।”
উদ্যোক্তাদের জন্য সুস্পষ্ট নীতি প্রয়োজন
নারী উদ্যোক্তাদের উন্নয়নে তথ্যভিত্তিক সহযোগিতা প্রদান এবং একটি সুস্পষ্ট নীতি গ্রহণ করা জরুরি। সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো যদি এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়, তাহলে নারী উদ্যোক্তারা তাদের ব্যবসার প্রসার ঘটাতে পারবেন।
কোহিনুর ইয়াছমিন মনে করেন, “আমাদের উদ্যোক্তাদের জন্য বাজার গবেষণা, ডিজাইন প্রশিক্ষণ, পণ্যের গুণগত মান উন্নয়ন এবং বিদেশি বাজার সম্পর্কে বিশদ তথ্য সংগ্রহের ব্যবস্থা করা দরকার। সরকার এবং উদ্যোক্তাদের নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলোর একসঙ্গে বসে পরিকল্পনা করা উচিত, যাতে উদ্যোক্তারা প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ববাজারে নিজেদের সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারেন।”
উপসংহার
বাংলাদেশের নারী উদ্যোক্তারা সম্ভাবনাময় একটি খাত তৈরি করেছেন। তবে তারা যদি সঠিক তথ্য, প্রশিক্ষণ এবং অর্থায়ন সুবিধা পান, তাহলে তাদের অগ্রযাত্রা আরও ত্বরান্বিত হবে। নারী উদ্যোক্তাদের বিকাশে তথ্যভিত্তিক সহায়তা নিশ্চিত করা এবং আন্তর্জাতিক বাজার ধরার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।