দেশের ব্যাংক খাতের ঋণমান নেতিবাচক করেছে মুডিস

আন্তর্জাতিক রেটিং এজেন্সি মুডিস জানিয়েছে, সম্পদের মানের অবনতি, উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং দুর্বল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এ কারণে সংস্থাটি দেশের ঋণমান ‘বি-ওয়ান’ থেকে কমিয়ে ‘বি-টু’তে নামিয়েছে। অর্থাৎ, মুডিসের পূর্বাভাস ‘স্থিতিশীল’ থেকে ‘নেতিবাচক’ অবস্থায় চলে গেছে।
বিশ্বখ্যাত ক্রেডিট রেটিং সংস্থা মুডিস আজ বুধবার একটি বিশদ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যেখানে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের সাম্প্রতিক চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ব্যাংকগুলোর সম্পদের ঝুঁকি বাড়ছে এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে, যা ব্যাংকগুলোর মুনাফা ও স্থিতিশীলতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হ্রাস ও মূল্যস্ফীতি
মুডিস পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রকৃত জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৪.৫ শতাংশে নেমে আসবে, যা আগের বছরের ৫.৮ শতাংশের তুলনায় ১.৩ শতাংশ কম। সংস্থাটির মতে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি মন্থর হয়ে যাওয়ায় এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে ব্যাংক খাতের কার্যক্রম চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে বিভিন্ন প্রতিকূলতার সম্মুখীন হচ্ছে, যার মধ্যে রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা, তৈরি পোশাকশিল্পের সরবরাহ শৃঙ্খলে ব্যাঘাত, এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা হ্রাস অন্যতম। বিশেষ করে, দেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাকশিল্পে প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, যা সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা নষ্ট করছে।
অন্যদিকে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক নীতিগত সুদের হার ১৫ মাসের ব্যবধানে ৬ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করেছে। তবে উচ্চ সুদহার সত্ত্বেও মূল্যস্ফীতি উল্লেখযোগ্য হারে কমেনি। মুডিসের পূর্বাভাস অনুযায়ী, চলতি বছরের গড় মূল্যস্ফীতি প্রায় ৯.৮ শতাংশে থাকতে পারে, যা সাধারণ ভোক্তা ও বিনিয়োগকারীদের জন্য উদ্বেগজনক।
খেলাপি ঋণের উচ্চহার ও ব্যাংক খাতের ঝুঁকি
মুডিসের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের অন্যতম বড় সমস্যা হিসেবে খেলাপি ঋণের ক্রমবর্ধমান হারকে চিহ্নিত করা হয়েছে। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের হার ১৭ শতাংশে পৌঁছেছে, যা ৯ মাস আগে ছিল ৯ শতাংশ। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে ঋণ খেলাপির হার এতটা বৃদ্ধি পাওয়া ব্যাংক ব্যবস্থার দুর্বলতা ও ঝুঁকির ইঙ্গিত দেয়।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ব্যাংকিং খাতে সুপরিকল্পিত সংস্কার না হলে ভবিষ্যতে এই সমস্যা আরও ঘনীভূত হতে পারে। বর্তমানে বিভিন্ন ব্যাংকে মূলধনের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে, যা আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য উদ্বেগজনক। বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর অধিকাংশেই বড় পরিমাণে অনাদায়ী ঋণ রয়েছে, যা সার্বিক ব্যাংকিং খাতের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে।
বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের পর্যবেক্ষণ
বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) আগেও বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সংস্থাগুলোর মতে, দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার স্বচ্ছতা বাড়াতে আরও কার্যকর নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
আইএমএফের মতে, বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত কড়াকড়িভাবে ঋণ অনুমোদন নীতি কার্যকর করা এবং যথাযথ নজরদারি নিশ্চিত করা, যাতে খেলাপি ঋণের হার নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে কৌশলগত সংস্কার প্রয়োজন, যার মধ্যে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও করপোরেট গভর্ন্যান্স উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের বর্তমান সংকট কাটিয়ে উঠতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি সংস্কার জরুরি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা কমাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি, নতুন বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে এবং আর্থিক স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে কার্যকর নীতিমালা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
বর্তমানে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত যে সংকটের মধ্যে রয়েছে, তা কাটিয়ে ওঠার জন্য একটি সমন্বিত কৌশল প্রয়োজন। সুদহার নিয়ন্ত্রণ, ঋণ ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা এবং আর্থিক খাতের ডিজিটালাইজেশন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
বিশ্লেষকদের মতে, ব্যাংকিং খাতের বর্তমান সংকট যদি দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে তা সামগ্রিক অর্থনীতির ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তাই এখনই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি, যাতে দেশের ব্যাংকিং খাত ভবিষ্যতে আরও স্থিতিশীল ও কার্যকর হতে পারে।