অর্থনীতি

অর্থনীতির সংস্কার করেছিলেন সাইফুর রহমান

প্রয়াত অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান ছিলেন এক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনীতিবিদ এবং দেশপ্রেমিক অর্থনীতিবিদ। তাঁর নেতৃত্বে দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক সংস্কার সাধিত হয়। সমাজের সব শ্রেণির মানুষের জীবনমান উন্নয়নে তিনি কাজ করেছেন এবং দাতাদের সহায়তার ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতির ভিত্তি স্থাপন করেছেন। বাণিজ্য উদারীকরণ, রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য ভ্যাট আইন প্রবর্তন এবং মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার মতো যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত তিনি গ্রহণ করেন। এসব সংস্কারের সুফল বাংলাদেশ পেয়েছে দীর্ঘ সময় ধরে।

দেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তিন উপদেষ্টা সম্মিলিতভাবে ‘গুণীজন সংবর্ধনা’ অনুষ্ঠানে প্রয়াত অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানকে স্মরণ করেন। দৈনিক বণিক বার্তা ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)-এর যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এই সংবর্ধনার এটি ছিল সপ্তম পর্ব।

স্মরণীয় সংবর্ধনা ও সম্মাননা

আজ শুক্রবার রাজধানীর একটি পাঁচ তারকা হোটেলে অনুষ্ঠিত এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রয়াত অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানকে মরণোত্তর সম্মাননা জানানো হয়। তাঁর তিন নাতি—নাবিল ইলহান, এম সাফির রহমান ও এম বাসির রহমান সম্মাননা গ্রহণ করেন। উপস্থিত ছিলেন তাঁর দুই পুত্র এম কায়সার রহমান ও নাসের রহমান।

অনুষ্ঠানে বিআইডিএস-এর ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক কাজী ইকবাল স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন এবং দৈনিক বণিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন।

অর্থনীতির রূপান্তরে সাইফুর রহমানের ভূমিকা

১৯৭৬ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে সাইফুর রহমান অর্থ, বাণিজ্য এবং পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। এ সময়ে তিনি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সংস্কার কার্যক্রম চালু করেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল:

  • ভ্যাট আইন প্রবর্তন: ভ্যাট চালু করার মাধ্যমে তিনি দেশের রাজস্ব আয় বাড়ান এবং স্বনির্ভর অর্থনীতির ভিত তৈরি করেন।
  • বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধা চালু: তৈরি পোশাক খাতে ব্যাক-টু-ব্যাক ঋণপত্র ও বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধা প্রদান করে রপ্তানি বাণিজ্যকে ত্বরান্বিত করেন।
  • মুদ্রা বাজার সংস্কার: মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেন, যার ফলে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট হয় এবং রপ্তানি খাতে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পায়।
  • বেসরকারি খাতের বিকাশ: ব্যক্তি খাতের প্রসারে তিনি গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, যার ফলে দেশে শিল্পায়নের প্রসার ঘটে।

অর্থনীতিবিদ ও উপদেষ্টাদের স্মৃতিচারণ

স্মরণসভায় অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমি চাকরিজীবনে চমৎকার এই মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছি। তিনি ছিলেন তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন, বন্ধুসুলভ ও বাংলাদেশপ্রেমী। আমি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর থাকার সময় তিনজন অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে কাজ করেছি। কিন্তু সাইফুর রহমান রাজনীতিবিদ হওয়া সত্ত্বেও কখনো বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর অযাচিত হস্তক্ষেপ করেননি।’

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, ‘সাইফুর রহমান ছিলেন দূরদর্শী অর্থনীতিবিদ। ১৯৯১ সালে স্বৈরাচার সরকারের পতনের পর রিজার্ভ শূন্য ছিল। তখন আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংক বাজেট সহায়তার জন্য কঠিন শর্ত দেয়। তবে তিনি তা সুচিন্তিতভাবে প্রত্যাখ্যান করেন এবং নিজস্ব অর্থনৈতিক মডেল গড়ে তোলেন।’

সংস্কার ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা

ফাওজুল কবির খান আরও বলেন, ‘ভ্যাট আইন পাস হবে কি না, শেষ সময় পর্যন্ত নিশ্চিত ছিল না। সংসদে অধিকাংশ মন্ত্রী ও এমপি এই আইনের বিরুদ্ধে ছিলেন। কিন্তু একমাত্র সাইফুর রহমানই দেশের স্বার্থে এককভাবে অবস্থান নিয়েছিলেন।’

বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, ‘দেশের অর্থনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন হয়েছে, তবে সাইফুর রহমান যে ভিত্তি গড়ে দিয়ে গেছেন, তা অর্থনীতিকে টিকিয়ে রেখেছে। এখন সময় এসেছে অর্থনীতির পুনর্গঠনের।’

সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘সাইফুর রহমান ছিলেন অর্থনৈতিক সংস্কারের চ্যাম্পিয়ন। তিনি বেসরকারি খাত, রপ্তানি বাণিজ্য ও রাজনীতিতে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন। মুক্তবাজার অর্থনীতির পথে তিনি বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়েছিলেন এবং সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করেছেন।’

সাবেক অর্থসচিব জাকির আহমেদ খান বলেন, ‘সংস্কার কীভাবে করতে হয়, তা তিনি জানতেন। ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া ও ভ্যাট আইন চালুর মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে তিনি ব্যর্থ হলে পদত্যাগ করার ঘোষণাও দিয়েছিলেন। এটি তাঁর দেশপ্রেম এবং নীতির প্রতি অটল বিশ্বাসের প্রতিফলন।’

সাইফুর রহমানের অর্থনৈতিক দর্শন

সাইফুর রহমানের অর্থনৈতিক নীতিগুলো বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছে। তিনি আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতি গঠনের লক্ষ্যে কাজ করেছেন এবং দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ভিত্তি গড়ে তুলেছেন। তাঁর নেওয়া সংস্কারগুলোর কারণে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে।

উপসংহার

প্রয়াত অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের অর্থনৈতিক দর্শন, সংস্কারমূলক নীতি এবং কঠোর পরিশ্রম বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে শক্তিশালী করেছে। তিনি এমন এক সময়ে কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যখন অর্থনীতিকে চাঙ্গা করা চ্যালেঞ্জিং ছিল। তাঁর অবদান দেশের অর্থনৈতিক ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। আজকের অনুষ্ঠানে বক্তারা সেই মূল্যবান অবদানের কথা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button