অর্থনীতি

আমরা ঋণগ্রস্ত জাতিতে পরিণত হয়েছি: এনবিআর চেয়ারম্যান

বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে কর প্রদানকারী নাগরিকের সংখ্যা কম বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবদুর রহমান। তিনি বলেন, “আমরা ঋণগ্রস্ত জাতিতে পরিণত হয়েছি। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য বেশি ভ্যাট-ট্যাক্স আদায়ে অভিযান চালানো হবে।”

মঙ্গলবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে রাজশাহী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রাক-বাজেট মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।


বাংলাদেশের কর কাঠামো ও বর্তমান বাস্তবতা

এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান বলেন, “আমাদের কর ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে হবে। বর্তমানে দেশে ১ কোটি ১২ লাখ ব্যক্তি ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (টিআইএন) নিয়েছেন, কিন্তু এর মধ্যে রিটার্ন দাখিল করেন মাত্র ৪০ লাখ। আবার, তাদের মধ্যেও প্রায় ২৫-২৬ লাখ ব্যক্তি হয় কর দেন না, নয়তো সর্বনিম্ন কর পরিশোধ করেন। ফলে রাজস্ব আহরণে বড় একটি শূন্যতা তৈরি হচ্ছে।”

তিনি আরও বলেন, “বাকি যারা আছেন, তাদের চিহ্নিত করে নোটিশ পাঠানো হচ্ছে। তবে আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ হলো, বিশ্বে বাংলাদেশের মতো এত কম ট্যাক্স প্রদানকারী জাতি আর নেই। এটি একটি বাস্তব সত্য।”


বাজেট ঘাটতি ও ঋণ নির্ভরতা

এনবিআর চেয়ারম্যানের মতে, গত ৫২-৫৩ বছর ধরে ঋণের ওপর নির্ভর করে বাজেট তৈরি করার ফলে দেশ ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, “আমরা যে আয় করি, তা ব্যয়ের তুলনায় কম। ফলে ঘাটতি মেটাতে প্রতিবছর সরকার নতুন ঋণ নিতে বাধ্য হয়। এর ফলে আর্থিক সংকট তৈরি হচ্ছে।”

তিনি জানান, “এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে হলে আমাদের করের আওতা বাড়াতে হবে। কর প্রশাসনকে স্বয়ংক্রিয় করতে হবে এবং কর আদায়ের প্রক্রিয়াকে সহজ করতে হবে।”


ভ্যাট ও কর সংগ্রহে নতুন উদ্যোগ

তিনি বলেন, “এই বছর বাজেটে জনগণের জীবনযাত্রা সহজ করতে বড় ধরনের সংস্কার আনা হবে। এনবিআর কর্মকর্তারা মাঠপর্যায়ে কাজ করবেন এবং রাজস্ব আদায়ে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে। আমাদের কর ব্যবস্থাকে আরও দক্ষ ও জনবান্ধব করতে ডিজিটালাইজেশন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।”

তিনি আরও বলেন, “বর্তমানে রাষ্ট্রের ব্যয় বেড়েছে, কিন্তু ভ্যাট-ট্যাক্স আদায় তেমন বাড়েনি। ফলে সরকার আর্থিক সংকটে পড়েছে। ১৯৯১ সালের ভ্যাট আইন পরিবর্তনের পর থেকে এ সমস্যা আরও প্রকট হয়েছে।”

তিনি জানান, “বর্তমানে করপোরেট ট্যাক্স আদায় অনলাইনের মাধ্যমে করা হচ্ছে। কর প্রদান আরও সহজ করতে আমরা বিভিন্ন নীতিগত পরিবর্তন আনছি, যাতে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে কর প্রদান করে।”


কর প্রদানে জনগণের অসচেতনতা ও প্রশাসনিক দুর্বলতা

বাংলাদেশের কর সংগ্রহের ক্ষেত্রে অন্যতম বড় সমস্যা হলো জনগণের অনীহা ও প্রশাসনিক দুর্বলতা। এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, “আমাদের জনগণের মধ্যে কর প্রদানের প্রবণতা কম। কর দেওয়াকে অনেকেই ঝামেলা মনে করেন। পাশাপাশি, কর প্রশাসনের দুর্বলতার কারণে অনেকে কর ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ পান। এসব সমস্যা কাটিয়ে উঠতে হবে।”

তিনি বলেন, “অনেক দেশেই কর দেওয়া নাগরিক দায়িত্ব হিসেবে বিবেচিত হয়, কিন্তু আমাদের দেশে এটি এখনও বাধ্যবাধকতা হিসেবেই দেখা হয়। এটি পরিবর্তন করা প্রয়োজন।”


উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের ভূমিকা

এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, “দেশের ব্যবসায়ীরা কর পরিশোধে বড় ভূমিকা রাখতে পারেন। আমরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কাজ করতে চাই, যাতে তারা নিয়মিত কর পরিশোধ করেন এবং কর নেটওয়ার্কে আরও বেশি প্রতিষ্ঠান যুক্ত হয়।”

তিনি আরও বলেন, “৩ কোটি টাকার ওপর বার্ষিক টার্নওভার রয়েছে, এমন প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য কর কাঠামো সহজ করা হবে, যাতে তারা নিয়মিত কর প্রদান করতে উৎসাহিত হয়।”


ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন

এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, “বাংলাদেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে হলে কর ব্যবস্থাকে আরও স্বচ্ছ ও কার্যকর করতে হবে। দেশের মানুষ আরও ভালো জীবনযাপনের যোগ্য, এবং এটি নিশ্চিত করতে আমাদের রাজস্ব ব্যবস্থাকে আধুনিক করতে হবে।”

তিনি বলেন, “আমরা চাই, সবাই নিয়ম মেনে কর প্রদান করুক। কর ব্যবস্থা যদি স্বচ্ছ হয়, তাহলে সাধারণ মানুষও কর দিতে আগ্রহী হবে। আর তখনই আমরা ঋণনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবো।”


উপসংহার

বাংলাদেশের কর আদায় ব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরে দুর্বল অবস্থায় রয়েছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য এনবিআর কর্তৃপক্ষ নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করছে, যাতে করের আওতা বৃদ্ধি পায় এবং দেশের রাজস্ব ঘাটতি কমে।

সরকার ও জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কর প্রদান প্রক্রিয়া সহজ ও কার্যকর করা গেলে দেশের আর্থিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে এবং বাংলাদেশ ধীরে ধীরে ঋণনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button