আঞ্চলিক

সুরক্ষা চেয়ে মেয়ের মামলা, আদালতে মা-বাবা

১৯ বছরের তরুণী মেহরীন আহমেদ ঢাকার আদালতে অভিযোগ করে বলেন, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে তিনি নিজের সুরক্ষার দাবিতে বাবা-মায়ের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। আদালতের সামনে তিনি জানান, “আমি তাদের পুতুল নই, আমি মানুষ – আমার অধিকার চাই।”

আদালতে মেহরীনের অভিযোগ

ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট এম এ আজহারুল ইসলামের আদালতে বৃহস্পতিবার (১০ জুলাই) হাজির হয়ে এক অভাবনীয় অভিযোগ তুলেছেন ১৯ বছরের এক তরুণী। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ুয়া মেহরীন আহমেদ অভিযোগ করেছেন—তার বাবা-মা তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে।

আদালতের বাইরে সংবাদকর্মীদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে মেহরীন বলেন, “আমি মা-বাবার পাপেট নই। তারা আমার স্বাধীনতা হরণ করেছেন। আমাকে গালিগালাজ, অপমান ও হেনস্তা করেছেন। আমি চাই, এই ভিডিও ভাইরাল হোক। আমি ন্যায়বিচার চাই। আমি সুরক্ষা চাই।”

শুনানির দিন আদালতে উপস্থিত ছিলেন তার মা জান্নাতুল ফেরদৌস ও বাবা নাসির আহমেদ। তারা কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখালেও আদালতে তাদের আইনজীবী বলেন, তারা মেয়ের নিরাপত্তার বিষয়ে আন্তরিক।

মামলার অভিযোগ : পরিবার থেকেই নির্যাতনের শিকার

মামলার আবেদনে বলা হয়েছে, গত ২৫ মে সন্ধ্যায় রাজধানীর মোহাম্মদপুরে নিজেদের বাসায় বাবা-মা মিলে মেহরীনকে শারীরিকভাবে আঘাত করেন এবং অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন। শুধু শারীরিক নয়, মেহরীন দাবি করেন, তাকে মানসিকভাবে ভেঙে ফেলার চেষ্টাও করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, “তারা আমাকে ব্রেইন অ্যান্ড মাইন্ড হাসপাতালে দুই বছর ভর্তি রেখেছিল। সেখানে আমাকে ওষুধ খাইয়ে মনোবিদের কাছে পাঠানো হতো। এটা কি সুরক্ষা না কি নির্যাতন?”

মেহরীন বলেন, তার স্বাধীন জীবনযাপনে বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে, পরিবারের দৈনন্দিন জিনিসপত্র ব্যবহার করতে দেওয়া হয়নি এবং মৌলিক অধিকার থেকেও তাকে বঞ্চিত করা হয়েছে।

আদালতের প্রক্রিয়া ও আইনজীবীদের বক্তব্য

বাদীপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইসফাকুর রহমান গালিব বলেন, “বয়ঃসন্ধিকাল থেকেই মেহরীন তার পরিবারে অবহেলা ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছেন। তিনি পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইন, ২০১০ এর আওতায় সুরক্ষা আদেশ ও জীবনযাপনের প্রয়োজনীয় খরচ চেয়েছেন।”

অন্যদিকে, বিবাদীপক্ষের আইনজীবী আবুল হোসেন বলেন, “মেহরীন তার মা-বাবার একমাত্র সন্তান। তারা চান মেয়ের সুরক্ষা নিশ্চিত হোক। দেশের বাইরে পাঠিয়ে উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থাও করবেন।”

আদালত শুনানি শেষে আদেশ মুলতবি রেখেছেন। পরবর্তী দিনে সিদ্ধান্ত জানানো হবে।

মেহরীনের পরিবার ও অতীত

জানা গেছে, মেহরীনের বাবা নাসির আহমেদ একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে উচ্চ পদে কর্মরত, এবং মা জান্নাতুল ফেরদৌস একটি বেসরকারি গ্রুপে ব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত। বাহ্যিকভাবে এই পরিবারটি উচ্চশিক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত হলেও ভেতরে চলছিল টানাপোড়েন।

এটি প্রথম নয়—মেহরীন এর আগেও পারিবারিক সহিংসতা নিয়ে সহপাঠীদের কাছে বিভিন্ন ইঙ্গিত দিয়েছেন। কিছু ভিডিও ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার আবেগঘন বক্তব্যগুলো ভাইরাল হওয়ায় বিষয়টি আরও আলোচনায় এসেছে।

সামাজিক প্রতিক্রিয়া : নেটিজেনদের দুই ভাগ

এই ঘটনার পর নেট দুনিয়ায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। অনেকে সাহসী হয়ে দাঁড়ানোর জন্য মেহরীনকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। আবার কেউ কেউ বলছেন, পারিবারিক বিষয়ে এতটা সামনে আসা কি ঠিক হলো?

বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি একটি সতর্ক সংকেত—শুধু বাহ্যিক আর্থিক বা সামাজিক প্রতিষ্ঠা দিয়ে একটি পরিবারকে সুখী বা নিরাপদ মনে করা যায় না।

মানসিক স্বাস্থ্যের প্রশ্ন

এই ঘটনার পেছনে মানসিক স্বাস্থ্যও একটি বড় ইস্যু হয়ে উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সন্তানদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল না রেখে অভিভাবকদের একচেটিয়া সিদ্ধান্ত অনেক সময় বিষিয়ে তোলে পুরো পরিবার।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. সাদিয়া নওরিন বলেন, “কিশোর-কিশোরীদের ক্ষেত্রে মানসিক ট্রমা অনেক গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করতে পারে। পরিবারই যদি সেই ট্রমার উৎস হয়, তবে সুরক্ষা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।”

এবার কী হতে যাচ্ছে?

এই মামলার রায় যাই হোক না কেন, এটি সমাজে এক নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে—পারিবারিক নির্যাতনের চুপচাপ থাকা আর চলবে না। সন্তানদের স্বাধীনতা, মানসিক নিরাপত্তা এবং ভালোবাসা পাওয়া তাদের জন্মগত অধিকার।

তবে বিশ্লেষকদের মতে, পরিস্থিতি কীভাবে মোড় নেবে তা নির্ভর করছে আদালতের পরবর্তী সিদ্ধান্ত ও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের ওপর।

এম আর এম – ০২৭৭, Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Advertisement
Back to top button