প্রযুক্তি

চীনের বেইনাও-১, নিউরালিঙ্কের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রযুক্তি উদ্ভাবন

Advertisement

আধুনিক মস্তিষ্ক–কম্পিউটার ইন্টারফেস প্রযুক্তিতে বিশ্বদ্বন্দ্বর নতুন অধ্যায়

২০২৫ সালের জুলাই, বেইজিং থেকে একটি চমকপ্রদ খবর এল—চীনের মস্তিষ্ক–কম্পিউটার ইন্টারফেস (Brain-Computer Interface বা BCI) প্রযুক্তি এখন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। মাস্টারমাইন্ড ইলন মাস্কের ‘নিউরালিঙ্ক’কে টক্কর দিতে শুরু করেছে বেইজিংয়ের ‘বেইনাও-১’। গবেষণার সাম্প্রতিক প্রমাণ এমনটাই বলছে যে, এই প্রযুক্তি শুধু চিকিৎসা ক্ষেত্রেই নয়, বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রেও ভবিষ্যতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

‘বেইনাও-১’: চীনের নতুন মস্তিষ্ক প্রযুক্তির অবতার

মার্চ মাসে বেইজিংয়ের এক সরকারি হাসপাতালে ৬৭ বছর বয়সী একজন অ্যামিওট্রফিক ল্যাটারাল স্ক্লেরোসিস (ALS) রোগীর চিন্তা থেকে কম্পিউটারের স্ক্রিনে ভেসে উঠল ‘আমি খেতে চাই’—যা তিনি বলতে পারছিলেন না। এই বাক্যটি প্রকাশ পেয়েছিল ‘বেইনাও-১’ নামক চীনা মস্তিষ্ক-কম্পিউটার ইন্টারফেস প্রযুক্তির মাধ্যমে। এই প্রযুক্তি সরাসরি মস্তিষ্ক থেকে সঙ্কেত সংগ্রহ করে তা পাঠ্যে রূপান্তর করে, ফলে কথা বলতে না পারা রোগীরাও ভাব প্রকাশ করতে সক্ষম হচ্ছেন।

চীনের ইনস্টিটিউট ফর ব্রেইন রিসার্চ (CIBR)-এর পরিচালক লুও মিনমিন জানান, ‘রোগীদের কাছে এই প্রযুক্তির চাহিদা অত্যন্ত প্রবল। তারা বলছেন, এটি যেন তাদের হারানো পেশির নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে দিয়েছে।’ তিনি আরও জানান, আগামী এক বছরে ৫০ থেকে ১০০ জন রোগীর শরীরে এই চিপ বসানোর পরিকল্পনা রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র বনাম চীন: প্রযুক্তির দ্বৈরথ

২০২৪ সালের মে মাস পর্যন্ত ‘বেইনাও-১’ প্রযুক্তির মাধ্যমে পাঁচজন রোগীর শরীরে চিপ বসানো হয়েছে। এই সংখ্যা প্রায় সমান ইলন মাস্কের নিউরালিঙ্কের পরীক্ষামূলক ব্যবহারকৃত রোগীর সংখ্যার। অপরদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের ‘সিনক্রোন’ নামক আরেক প্রতিষ্ঠান ১০ জন রোগীর ওপর পরীক্ষা চালিয়েছে, যার মধ্যে ৬ জন যুক্তরাষ্ট্রে এবং ৪ জন অস্ট্রেলিয়ায়।

জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোসায়েন্স বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম্যাক্সিমিলিয়ান রিসেনহুবার বলেন, ‘চীন যদিও প্রযুক্তিতে দেরিতে হাত দিয়েছে, কিন্তু দ্রুত অগ্রগতি করছে। এখন তারা যুক্তরাষ্ট্রকে কঠোর চ্যালেঞ্জ দিচ্ছে, এমনকি কিছু ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শকও হয়ে উঠছে।’

মস্তিষ্ক প্রযুক্তির বৈশ্বিক বাজার ও কৌশলগত গুরুত্ব

বিশ্বব্যাপী মস্তিষ্ক-কম্পিউটার ইন্টারফেস প্রযুক্তির বাজার ২০২৪ সালে ছিল প্রায় ২.৬ বিলিয়ন ডলার। আর ২০৩৪ সালের মধ্যে এই বাজার ১২.৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানোর সম্ভাবনা রয়েছে। শুধু অর্থনৈতিক দিক থেকেই নয়, এটি জাতীয় নিরাপত্তা, কৌশলগত ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংও বারবার এই প্রযুক্তিকে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার প্রধান রণক্ষেত্র হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ‘প্রযুক্তি ও বৈজ্ঞানিক গবেষণা দেশের শক্তির মাপকাঠি।’

চীনের ‘বেইনাও-১’ ও নিউরালিঙ্কের প্রযুক্তিগত পার্থক্য

ইলন মাস্কের নিউরালিঙ্ক প্রযুক্তি মস্তিষ্কের গভীর অংশে চিপ বসায়, যেখানে সংকেত সংগ্রহ বেশ নির্ভুল হয়, তবে এটি অস্ত্রোপচারের ঝুঁকিপূর্ণ। অপরদিকে, ‘বেইনাও-১’ চিপ মস্তিষ্কের বাইরে থেকে, ডিউরা ম্যাটারের উপর দিয়ে সংকেত সংগ্রহ করে, যা তুলনামূলক কম ঝুঁকিপূর্ণ। যদিও এটি প্রতিটি নিউরনের সংকেত ধরা খুব সূক্ষ্ম নয়, তবে বৃহত্তর মস্তিষ্ক এলাকা থেকে তথ্য সংগ্রহে সক্ষম।

লুও মিনমিন বলেন, ‘আমাদের প্রযুক্তি ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং একসঙ্গে রোগীর জন্য সেরা বিকল্প হতে পারে।’

মস্তিষ্ক–কম্পিউটার ইন্টারফেস প্রযুক্তির ইতিহাস ও উন্নয়ন

যুক্তরাষ্ট্রের ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেস প্রযুক্তির শুরু ১৯৭০-এর দশকে। ২০১৩ সালে ওবামা প্রশাসনের ‘ব্রেইন ইনিশিয়েটিভ’ প্রজেক্টে ৩ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ পাওয়ার পর থেকে এই প্রযুক্তির উন্নতি বিশেষ ত্বরান্বিত হয়।

চীন ১৯৯০-এর দশকে এই ক্ষেত্রে প্রবেশ করলেও, ২০১৬ সালে পাঁচ বছরের পরিকল্পনায় এই প্রযুক্তিকে অগ্রাধিকার দেয়। ২০২৩ সালে চীন প্রথমবারের মতো মস্তিষ্ক প্রযুক্তি গবেষণার জন্য নৈতিক নির্দেশিকা প্রকাশ করে এবং বড় শহরগুলো যেমন বেইজিং ও সাংহাই দ্রুত ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ও বাণিজ্যিকীকরণের পথ প্রশস্ত করছে।

ভবিষ্যৎ: চিকিৎসা থেকে মানব জীবনের রূপান্তর

এই প্রযুক্তির সবচেয়ে বড় উপকার হচ্ছে আলঝেইমার, ALS, প্যারালাইসিসসহ বিভিন্ন মস্তিষ্কজনিত রোগের রোগীদের জীবনে নতুন আশার আলো দেখা। রোগীরা যেমন কথা বলতে বা যন্ত্র চালাতে পারছেন, তেমনি ভবিষ্যতে এটি আরও বিস্তৃত মানব ক্ষমতা বৃদ্ধির সম্ভাবনা রাখে—যেমন স্মৃতিশক্তি বাড়ানো, নতুন দক্ষতা অর্জন এবং সম্ভাব্য মানসিক অসুস্থতা নিরাময়।

লুও মিনমিন বলেন, ‘আমরা চাই এই প্রযুক্তি দ্রুত সবার জন্য উপলব্ধ হোক, যাতে মানুষ জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে পারে।’

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button