২০২৫ সালের প্রথম ১১ মাসেই চীনের মোট বাণিজ্য উদ্বৃত্ত প্রথমবারের মতো ১ ট্রিলিয়ন ডলারের অঙ্ক ছাড়িয়ে রেকর্ড গড়েছে। চীন সরকারের প্রকাশিত শুল্ক বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত চীনের মোট বাণিজ্য উদ্বৃত্ত দাঁড়িয়েছে প্রায় ১.০৮ ট্রিলিয়ন ডলার, যা এক বছরে দেশটির ইতিহাসে সর্বোচ্চ রেকর্ড। সোমবার (৮ ডিসেম্বর) ইউএস সংবাদমাধ্যম সিএনএন নিউজ এবং নিক্কেই এশিয়া এই তথ্য নিশ্চিত করেছে। এই রেকর্ড অর্জন এমন এক সময়ে হলো, যখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রফতানি বাণিজ্য টানা আট মাস ধরে ‘আশঙ্কাজনক’ অবস্থায় রয়েছে এবং ভূ-রাজনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে অচলাবস্থা বিদ্যমান।
বাণিজ্য উদ্বৃত্তে রেকর্ড: পরিসংখ্যানের বিশ্লেষণ
চীন সরকারের শুল্ক বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের প্রথম ১১ মাসে দেশের সামগ্রিক বাণিজ্যের চিত্রটি নিম্নরূপ:
- মোট বাণিজ্য উদ্বৃত্ত: প্রায় ১.০৮ ট্রিলিয়ন ডলার (গত বছরের রেকর্ড ৯৯২ বিলিয়ন ডলারের চেয়ে বেশি)।
- রফতানি বৃদ্ধি: বছরের প্রথম ১১ মাসে মোট রফতানি গত বছরের তুলনায় ৫.৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
- আমদানি বৃদ্ধি: আমদানি মাত্র ০.৬ শতাংশ কমেছে।
গত নভেম্বরে চীনের রফতানি ডলারের হিসেবে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ বেড়ে মোট ৩৩০ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। এটি অক্টোবরে অপ্রত্যাশিত ১.১ শতাংশ সংকোচনের পর নতুন করে আশার ইঙ্গিত দিচ্ছে দেশটির বাণিজ্য খাতে। রয়টার্সের জরিপে আড়াই শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু বাস্তবে তা দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে।
অন্যদিকে, নভেম্বরে আমদানি বেড়েছে ১ দশমিক ৯ শতাংশ (মোট ২১৮.৬ বিলিয়ন ডলারে), যা রয়টার্সের ৪ শতাংশ পূর্বাভাস থেকে কম। এই শক্তিশালী রফতানি প্রবৃদ্ধি চীনের আবাসন খাতে মন্দা এবং কম ঘরোয়া ব্যয়কেও ছাপিয়ে গেছে।
মার্কিন বাজারে রফতানিতে বিপর্যয়
চীনের সামগ্রিক রফতানি শক্তিশালী অবস্থানে থাকলেও, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রফতানি বাণিজ্যে মন্দাভাব অব্যাহত রয়েছে।
- রফতানি হ্রাস: নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রগামী রফতানি গত বছরের তুলনায় প্রায় ২৯ শতাংশ কমেছে, যা টানা আট মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। অক্টোবরেও এই পতন ছিল ২৫ শতাংশ।
- ট্রেড ওয়ার: যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অঘোষিত ‘ট্রেড ওয়ার’ এখনও বাণিজ্যকে প্রভাবিত করছে। যদিও গত অক্টোবরের শেষের দিকে চীনা প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দক্ষিণ কোরিয়ায় সাক্ষাৎ করে বাণিজ্য যুদ্ধ স্থগিত রাখার ব্যাপারে সম্মত হয়েছিলেন, তবুও মার্কিন বাজারে এর প্রভাব ধারাবাহিকভাবে কমছে।
এই পরিস্থিতি প্রমাণ করে যে, ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা সরাসরি বাণিজ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে চীনা পণ্যের চাহিদা বাড়ায় সামগ্রিক রফতানি স্থিতিশীল রয়েছে।
ভবিষ্যতের লক্ষ্য: বৈদ্যুতিক গাড়ি ও প্রযুক্তি
রফতানি এখনও শক্ত অবস্থানে থাকায় চীন এ বছর প্রায় ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য অর্জনের সম্ভাবনা দেখাচ্ছে। দেশটি আগামী বছরগুলোতে বৈশ্বিক বাজারে রফতানি আরও বাড়ানোর লক্ষ্য জানিয়েছে।
- অগ্রাধিকার: চীন বৈদ্যুতিক গাড়ি (Electric Vehicles), ব্যাটারি, রোবটিকস এবং উন্নত উৎপাদনশিল্পকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। এই উচ্চ প্রযুক্তিনির্ভর শিল্পগুলোই আগামীতে চীনের রফতানির প্রধান চালিকাশক্তি হবে।
- মরগান স্ট্যানলির পূর্বাভাস: মরগান স্ট্যানলির পূর্বাভাস বলছে, ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক রফতানি বাজারে চীনের শেয়ার ১৬ দশমিক ৫ শতাংশে পৌঁছাতে পারে।
নমুরার প্রধান চীনা অর্থনীতিবিদ লু টিং বলেন, চীনের রপ্তানি তুলনামূলকভাবে ভালোভাবে ধরে রেখেছে এবং এই স্থিতিশীলতা আগামী বছরের মোট রফতানি বৃদ্ধির পূর্বাভাস প্রায় ৪ শতাংশে স্থির করার ভিত্তি তৈরি করেছে।
ভূ-রাজনৈতিক সম্পর্ক ও বৈশ্বিক বাণিজ্য পরিবেশ
বাণিজ্য উদ্বৃত্তে রেকর্ড সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র-চীন ভূ-রাজনৈতিক সম্পর্কে অচলাবস্থা থাকায় বৈশ্বিক বাণিজ্য পরিবেশ কতটা স্থায়ী হবে, তা নিয়ে শঙ্কা রয়ে গেছে।
- আমদানি নিয়ন্ত্রণ শিথিল: বাণিজ্য চুক্তি হওয়ার পর দুই দেশের মধ্যে আংশিক শুল্ক ছাড় এবং রেয়ার আর্থ রফতানি নিয়ন্ত্রণ শিথিলের মতো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হলেও, মার্কিন বাজারে চীনা পণ্যের রফতানি বৃদ্ধি পায়নি।
- বাণিজ্য বাধা: লু টিং আরও জানান, ২০২৬ সালে চীনের রফতানি বৃদ্ধি দেশটির উৎপাদন শক্তির ওপর নির্ভর করবে। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বাণিজ্য বাধার কারণে বৃদ্ধির গতি কিছুটা ধীর হতে পারে।
এই পরিস্থিতি চীনকে বৈশ্বিক বাণিজ্য কৌশলে পরিবর্তন আনতে এবং মার্কিন বাজার নির্ভরতা কমাতে নতুন অংশীদারদের ওপর মনোযোগ দিতে বাধ্য করছে।
অর্থনৈতিক পরাশক্তি চীনের নতুন রেকর্ড
২০২৫ সালের প্রথম ১১ মাসেই চীনের বাণিজ্য উদ্বৃত্তের রেকর্ড ১ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়ানো দেশটির অর্থনৈতিক শক্তির এক বড় প্রমাণ। মার্কিন বাজারের তীব্র মন্দা সত্ত্বেও এই রেকর্ড অর্জন বিশ্ব অর্থনীতিতে চীনের উৎপাদন শক্তি এবং অন্যান্য উদীয়মান বাজারে চাহিদা বৃদ্ধির ওপর ভিত্তি করে হয়েছে। তবে চীনের এই অর্থনৈতিক সাফল্য বজায় রাখা নির্ভর করবে ভূ-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং বৈদ্যুতিক গাড়ির মতো উচ্চ প্রযুক্তির রফতানিতে তাদের ধারাবাহিক সাফল্যের ওপর।
এম আর এম – ২৫৪৫, Signalbd.com



